নিউজ ডেস্ক :: গত কয়েকদিন থেকে হঠাৎ করে রাজধানীসহ সারা দেশে বিদ্যুতের তীব্র লোডশেডিং দেখা দিয়েছে। রাজধানীতে গড়ে ৩-৪ ঘণ্টা এবং ঢাকার বাইরে গড়ে ৭-৮ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ায় যা গত কয়েক বছর ছিল অনুপস্থিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একদিকে করোনার একটা অভিঘাত, তার ওপরে এসেছে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ। এর ফলে এখন আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপকরণগুলোর দাম অত্যধিক বেড়ে গেছে। ডিজেল, তেল, এলএনজির দাম বেড়েছে। সব কিছুর দাম বেড়েছে। কয়লা এখন পাওয়া যায় না। অনেক দেশেই এখন বিদ্যুতের জন্য হাহাকার। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্টরা এটাকে বলছেন, ‘ফোর্স লোডশেডিং’। অর্থাৎ সঙ্গত কারণে কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় উৎপাদন করা হচ্ছে না। তাই লোডশেডিং হচ্ছে। উৎপাদন বাড়ালে লোডশেডিংয়ের প্রয়োজন পড়ত না। শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে জেনে-বুঝেই লোডশেডিং করা হচ্ছে। একটি এলাকায় একবারে আধা ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য রেশনিং করতে বলা হয়েছে।
কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল গ্যাসে স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়ায় প্রয়োজনীয় গ্যাস বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ২০২০ সালে যে গ্যাস প্রতি ইউনিট ৪ মার্কিন ডলারে কেনা গেছে, তা এখন বেড়ে ৩৮ ডলার ছাড়িয়েছে। সর্বশেষ স্পট মার্কেট থেকে কেনা হয় ২৫ ডলারে। তাতেই বিপুল টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়ে গেছে। বর্তমান দামে কিনলে যে পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হবে তা অসম্ভব। সে জন্য আপাতত গ্যাস আমদানি না করার পক্ষে সরকার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে।
দেশের বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসনির্ভর। ফলে গ্যাস সরবরাহের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম না কমা এবং দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস সরবরাহ না বাড়া পর্যন্ত এ সঙ্কট নিরসন হচ্ছে না বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিপিডিবি জানিয়েছে, মঙ্গলবার সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার মেগাওয়াট আর উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১৩ হাজার ৭০ মেগাওয়াট। রাজধানী ঢাকায় চাহিদা ছিল ৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। সারা দেশে ১ হাজার মেগাওয়াটের অধিক এবং ঢাকায় আড়াইশ মেগাওয়াটের অধিক বিদ্যুৎ ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণে রেশনিংয়ের মাধ্যমে লোডশেডিং করতে বলা হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, আরও আগেই দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া দরকার ছিল, তা হলে এখন এতে ভোগান্তিতে পড়তে হতো না। অথচ বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বাড়ার কারণে এখন পেট্রোবাংলা নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। তিনি বলেন, স্পট মার্কেটে দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার এলএনজি না কেনার সিদ্ধান্তের কারণেই এ সমস্যা হচ্ছে। এখন জ্বালানির খরচ কমাতেই লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। এ সঙ্কট মোকাবিলা করতে হলে আমাদের অপ্রয়োজনীয় গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে হবে। আশা করছি, এ সঙ্কট বেশি দিন থাকবে না, কারণ সামনে এলএনজি ও জ্বালানি তেলের দাম কমে আসবে।
বিদ্যুতের বর্তমান পরিস্থিতির জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, করোনা-পরবর্তী জ্বালানির চাহিদা এবং যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়েই চলেছে। এটা শুধু আমাদের নয়, এটা বৈশি^ক সমস্যা। সারা বিশ্ব যে সমস্যা গত ২-৩ মাস ধরে মোকাবিলা করছে সেটা আমরা ২-৩ দিন ধরে মোকাবিলা করছি। শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান এমনকি জাপান-অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশও এখন পরিকল্পিতভাবে দিনে দুই ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমাদের যে পরিমাণ গ্যাসের চাহিদা রয়েছে তার অর্ধেক আমাদের নিজস্ব গ্যাস। বাকিটা আমদানি করতে হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে এলএনজি ও জ্বালানি তেল আমদানি করতে উৎপাদন খরচ তিন-চার গুণ বেড়ে যাবে। যেখানে ৯ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়া হতো, এ অবস্থায় চলতে থাকলে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে, যা সরকারের পক্ষে অসম্ভব।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বলেন, আমরা আস্তে আস্তে আমদানি করা গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছি, আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াট, এ চাহিদা পূরণের জন্য আমাদের সক্ষমতা রয়েছে। মূল বিষয় হচ্ছে জ্বালানির জোগান। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৬ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করতে পারলে সঙ্কট হতো না। কিন্তু গত দুদিনে স্পট মার্কেটে এলএনজির মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। বর্তমানে স্পট মার্কেটের দামে এলএনজি কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যুক্তিসঙ্গত নয়। আপাতত কেনা হচ্ছে না। ফলে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র থেকে ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে। এতে দেড় থেকে ২ হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি হচ্ছে। সেটাই গত ২-৩ দিন ধরে সবার জন্য অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
তিনি বলেন, এটা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে, আমাদের সাশ্রীয় হওয়া। এর জন্য দোকানপাট, শপিংমল রাত ৮টার মধ্যে বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ঈদের জন্য সেটা আপাতত স্থগিত আছে। এরপর এটা কার্যকর করার পাশাপাশি আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পরশু (বৃহস্পতিবার) যে শর্টেজ থাকবে তা সবাই মিলে ভাগাভাগি করে নিলে তা আর অসহনীয় পর্যায়ে থাকবে না। কারণ অতীতে প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। এখন যদি দুয়েক ঘণ্টা লোডশেডিং মোকাবিলা করতে পারি তা হলে সেটি হবে দেশ ও নিজের স্বার্থে বড় পদক্ষেপ। বর্তমানের আড়াইশ থেকে তিনশ এমএমসিএফটি গ্যাস ঘাটতি রয়েছে বলে জানান তিনি।
গ্যাস সরবরাহ ও লোডশেডিং চিত্র
বাংলাদেশ তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ করপোরেশন পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩৭০ কোটি ঘনফুট। বিপরীতে গড়ে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা যেত। এর মধ্যে দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত হয় ২২০-২৩০ কোটি ঘনফুট। বাকি ৭০-৮০ কোটি ঘনফুট আমদানি করা হয়। তিন দিন ধরে সরবরাহ করা হচ্ছে দিনে ২৭৫-২৮০ কোটি ঘনফুট। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট।
পেট্রোবাংলা বলছে, মঙ্গলবার দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৯৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু ২৯ জুন ছিল ১ হাজার ৮১ মিলিয়ন ঘনফুট। এ দুদিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ কমাতে দেখা গেছে। এ গ্যাস-রেশনিংয়ের ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন কমেছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বই সাশ্রয়ী হচ্ছে। এলএনজির দাম কমলে স্পট থেকে আমদানি করা হবে। এখন দেশীয় উৎস থেকে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। গ্যাসের বিকল্প হিসেবে জ্বালানি তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। তবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামও চড়া। তেল আমদানি করে দিনে ১০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তাই তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
ঢাকার দুই বিতরণ কোম্পানি ডিপিডিসি ও ডেসকো জানিয়েছে, সব মিলিয়ে তাদের ৩০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ ঘাটতি হচ্ছে। ঘাটতি মেটাতে এলাকাভেদে ৩০ মিনিট করে লোডশেডিং করা হচ্ছে। গ্রাহকের ভোগান্তি কমাতে বিভিন্ন এলাকায় ভাগাভাগি করে লোডশেডিং করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ পরিস্থিতি ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকায়। সেখানে প্রতিদিন গড়ে ৭-৮ ঘণ্টা লোড শেডিং করা হচ্ছে।
দেশের ৫৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) জানিয়েছে, তারা ৮ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। গত রোববার ৮৫১ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে আরইবিকে। দিনে ৫-৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা।