অনুসন্ধান নিউজ :: অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় হুমকিতে পড়েছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পাঁচ গ্রাম। এসব গ্রামের অনেক স্থাপনাই এরই মধ্যে বিলীন হয়েছে। ভাঙন দেখা দিয়েছে গ্রামের অনেক এলাকায়।
স্থানীয়রা শঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, বালু উত্তোলন অব্যাহত থাকলে গ্রামের সব বাড়িঘর ও স্থাপনা হারিয়ে যাবে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বালু উত্তোলনকারীরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাশালী হওয়ায় বারবার বাধা দিলেও তারা কোনো আপত্তি শুনছে না। স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরও বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি। এই কাজে প্রশাসনের লোকজনও জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদীর কিছু এলাকা বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা দেয়া হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক মজির উদ্দিনকে ধলাই নদীর ১ নম্বর খতিয়ানের ৪৯৩, ৩৫৯, ১২১৩, ২০০২ নম্বর দাগের ১৯৯ একর জায়গা বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা দেয়া হয়।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, মজির উদ্দিন ও তার অনুসারীরা ইজারা এলাকা ছাড়াও অন্য স্থান থেকে বালু তুলছেন।
তাদের অভিযোগ, ধলাই নদীর কিছু এলাকা ইজারা নিলেও এই নদীর পাশ দিয়ে যাওয়া ডলা নামের খাল থেকেও নির্বিচারে বালু তুলছেন মজির। এতে হুমকিতে পড়েছে এই খালের পাশের ডলার পাড়, দক্ষিণ ডলার পাড়, উত্তর ডলার পাড়, রাজনগর ও মোস্তফানগর গ্রাম।
এসব গ্রামের ৩৫ হাজার বাসিন্দাও আছে শঙ্কায়। দুই মাস ধরে এভাবে বালু উত্তোলন চলছে বলে জানিয়েছেন তারা।
মঙ্গলবার সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ডলার খালে বালুবাহী কয়েক শ বাল্কহেড বারকি নৌকায় বালুবোঝাই করা হচ্ছে।
অর্ধশতাধিক ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। নির্বিচারে বালু উত্তোলনের ফলে ছোট খাল পরিণত হয়েছে বিশাল নদীতে। ভাঙন দেখা দিয়েছে আশপাশের গ্রামেও। এতে হুমকিতে পড়েছে গ্রামগুলোর স্কুল, মসজিদ, বাড়িঘরসহ বিভিন্ন স্থপনা।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাঁচ শতাধিক শ্রমিক বালু উত্তোলনে কাজ করছেন। তবে কারা তাদের কাজে নিয়োজিত করেছেন তা বলতে চাননি শ্রমিকরা।
বালু উত্তোলনে কয়েকটি গ্রাম হুমকিতে পড়ার কথা জানিয়ে রাজানগর গ্রামের স্কুলশিক্ষক বরকত উল্লাহ স্বপন বলেন, ‘ইজারা এলাকা ছাড়াই বড় বড় গর্ত করে নির্বিচারে বালু তোলা হচ্ছে। এভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত থাকলে এই পাঁচটি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’
তিনি জানান, তারা ১০০ ফুট গভীর গর্ত করে বালু তুলছে। এতে ইতোমধ্যে ডলার খালের পার্শ্ববর্তী এসব গ্রামের আটটি মসজিদ, পাঁচটি প্রাইমারি স্কুল, দুটি কমিউনিটি ক্লিনিকসহ অসংখ্য স্থাপনা ভাঙনের হুমকি দেখা দিয়েছে।
বরকতউল্লাহ বলেন, ‘একটা প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এই বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত। মানুষ তাদের কাছে জিম্মি। গ্রামের মানুষজন প্রতিবাদ করলে তারা সন্ত্রাসী ও পুলিশের ভয় দেখায়।’
স্থানীয় মোস্তফানগরের মামুন মিয়া বলেন, ‘নদীর পাড়েই আমার বাড়ি। ইতোমধ্যে বাড়ির আশপাশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এভাবে ভাঙন অব্যাহত থাকলে বাড়িঘরও তলিয়ে যাবে। বাড়ি চলে গেলে আমরা থাকবো কোথায়, আমাদের বাঁচান।’
যে জায়গা থেকে এখন বালু উত্তোলন করা হচ্ছে সেখানেই নিজের বাড়ি ছিল জানিয়ে রাজনগর এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহমান বলেন, ‘এখানেই আমার বাড়ি ছিল। বন্যায় তা তলিয়ে গেছে। এখন ওপরে নতুন করে বাড়ি করছি। কিন্তু যেভাবে বালু তোলা হচ্ছে তাতে আগামী বন্যায় এই ঘরও থাকবে না। এখন ঘর ভাঙলে আমি যাব কই?’
অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের দাবিতে উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন কাছে লিখিত আবেদন করেন স্থানীয় এলাকাবাসী। তবে তাতেও কাজ না হওয়ায় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদের কাছেও লিখিত আবেদন করেন তারা।
আবেদনে উল্লেখ করা হয়- ‘ড্রেজার মেশিন দিয়ে অভৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় পাঁচটি গ্রামের ভেতরে থাকা বিদ্যালয়, মসজিদ, এতিমখানা, মাদ্রাসা ও কবরস্থান ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গ্রামবাসী ইজারাদারকে বারবার নিষেধ করার পরও তা না শুনে বালু উত্তোলন করে চলছেন।’
আবেদনের পর প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন।
মন্ত্রীর সে নির্দেশেও কাজ হয়নি বলে জানান ডলার পাড় গ্রামের বাসিন্দা, উপজেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী-প্রশাসনের কাছে আবেদন করেও বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি। দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই ড্রেজার মেশিনে বালু তোলা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ধলাই নদীর কিছু অংশ বালু উত্তোলনের জন্য লিজ নেয়া হয়েছে। ডলা খাল ওই জায়গা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। এভাবে বালু তোলা হলে আগামী বর্ষায় পুরো এলাকা বিলীন হয়ে যাবে।’
তার অভিযোগ, বালু উত্তোলনের জন্য মজির উদ্দিন নদী ইজারা নেন। তার লোকজনই নদীর বাইরে এই খালে এসে বালু তুলছে।
নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক ও বালু মহালের ইজারাদার মজির উদ্দিন বলেন, ‘আমি নদী ইজারা নিয়েছি। কিন্তু বালু উত্তোলন করি না। বালু ব্যবসায়ীরা উত্তোলন করে। আমি কেবল ইজারা সংগ্রহ করি।’
ডলা খাল থেকে বালু উত্তোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইজারাবহির্ভূত এলাকা থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। শুনেছি স্থানীয় গ্রামবাসীই এসব বালু ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। স্থানীয়দের সহযোগিতা না থাকলে বাইরের মানুষজন কীভাবে বালু তুলে নিয়ে আসবে। অথচ তারাই এখন বিভিন্ন অভিযোগ করছে।’
ইজারাবহির্ভূত এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন হয় স্বীকার করে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত সিংহ বলেন, ‘ডলার খাল এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হয় বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ পেয়েছি। এমন অভিযোগ পেলে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাই। আজকেও (গত মঙ্গলবার) ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুটি নৌকাকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তবে অভিযানের সময় বালুর মালিক পাওয়া যায়নি।’
অবৈধ বালু উত্তোলনে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান ইউএনও।