জাফর ইকবালের অনুরোধে ১৬৩ ঘণ্টা পর অনশন ভাঙলেন শাবি শিক্ষার্থীরা

রিপোর্টার নামঃ
  • বুধবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২২
  • ১৯৮ বার পড়া হয়েছে

অনুসন্ধান নিউজ ::  অবেশেষে ১৬৩ ঘণ্টা পর ‘আমরণ অনশন’ ভাঙলেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ শিক্ষার্থী। আন্দোলনের ১৩ তম ও অনশনের ৮ম দিনে বুধবার (২২ জানুয়ারি) সকাল ১০টা ২০ মিনিটের সময় বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হক শিক্ষার্থীদের পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙান। তবে অনশন ভাঙলেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

এর আগে বুধবার ভোরে শিক্ষার্থীরা জানান, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এলেই অধ্যাপক জাফর ইকবালের উপস্থিতিতে সকালে একযোগে অনশন ভাঙবেন তারা। তার আগে জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ইয়াসমিন হকের সঙ্গে আলোচনার সময় এই প্রতিশ্রুতি দেন ক্যাম্পাসে অনশনরত শিক্ষার্থীরা।

মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাত ৩টা ৫৫ মিনিটে ঢাকা থেকে ক্যাম্পাসে আসেন শাবির সাবেক অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী (সাবেক অধ্যাপক) ইয়াসমিন হক।
আন্দোলনত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার সময় জাফর ইকবাল জানান, উচ্চ পর্যায়ে তার আলোচনা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। এ কারণেই তিনি ক্যাম্পাসে ছুটে এসেছেন। অনশন না ভাঙিয়ে তিনি ফিরে যাবেন না।

জাফর ইকবালের অনুরোধে অবশেষে অনশন ভাঙতে রাজি হন শিক্ষার্থীরা।

উল্লেখ্য, শাবিপ্রবির বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্টের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ এনে গত ১৩ জানুয়ারি দিনগত মধ্যরাতে ওই হলের ছাত্রীরা রাস্তায় নামেন। সেই থেকে এ আন্দোলনের সূচনা। একদিন পর (১৫ জানুয়ারি) আন্দোলনরতদের ওপর ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ ওঠে। এতে নতুন মাত্রা পায় আন্দোলন। হলের পুরো প্রভোস্ট কমিটির অপসারণ, অব্যবস্থপনা দূর, ছাত্রলীগের হামলার বিচার চেয়ে ১৬ জানুয়ারি শাবির আরও শিক্ষার্থী আন্দোলনে শামিল হন। সেদিন উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা। তাকে মুক্ত করতে গেলে পুলিশকে বাধা দেন আন্দোলনকারীরা। এতে উভয়পক্ষের সংঘর্ষ হয় এবং এতে পুলিশ ও শিক্ষকসহ অর্ধশতাধিক লোক আহত হন।
১৬ জানুয়ারির সংঘর্ষের ঘটনায় দুই থেকে তিনশ’ অজ্ঞাত শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ১৭ জানুয়ারি রাতে মামলা করে পুলিশ। মামলার এজাহারে পুলিশ লিখেছে, সেদিন শিক্ষার্থীরা পুলিশের ওপর গুলিও ছুঁড়েছিল। এ মামলা প্রত্যাহারে ১৮ জানুয়ারি রাত ১০টা পর্যন্ত আলটিমেটাম দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। তবে মামলা প্রত্যাহার না হওয়ায় ১৮ জানুয়ারি আরও উত্তপ্ত হয় শাবি ক্যাম্পাস।

ওইদিন ক্যাম্পাসের গোলচত্বরে অবস্থান নিয়ে দফায় দফায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের অপসারণ, প্রক্টর ও ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন ধরনের স্লোগানে মুখর ছিলো ক্যাম্পাস। ওইদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শিক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বার্তা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা ক্যাম্পাসে যান। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেলের সাথে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আশফাক আহমদ, মহানগরের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক বিধান কুমার সাহা ও সিসিক কাউন্সিলর ইলিয়াসুর রহমান। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে ভিসি অপসারণের আশ্বাস না পেয়ে আন্দোলন থেকে সরার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তারা উপাচার্যের অপসারণ চেয়ে গণসাক্ষর সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ বরাবরে চিঠি পাঠান।

আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯ জানুয়ারি দুপুর ১২টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন শিক্ষার্থীরা। এ সময়ের মধ্যে ভিসি পদত্যাগ না করায় পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ওইদিন বিকেল ৩টা থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন ২৪ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে একজনের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি বাড়ি চলে যান। বাকি ২৩ জনের সাথে ২২ জানুয়ারি আরও ৫ শিক্ষার্থী যোগ দেন।
২১ জানুয়ারি দুই দফায় শাবি ক্যাম্পাসে যান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নাদেল। তিনি শিক্ষার্থীদের সাথে মুঠোফোনে কথা বলিয়ে দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে। শিক্ষামন্ত্রী অনশন ভাঙতে ও আলোচনায় বসতে আহবান জানান শিক্ষার্থীদের। আলোচনার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দলকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান শিক্ষামন্ত্রী। প্রথমে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও পরে শিক্ষার্থীরা মত বদলে ফেলেন। তবে ২১ জানুয়ারি রাতে শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় যায়। পরদিন (২২ জানুয়ারি) তাঁরা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বাসায় বৈঠকে বসেন। বৈঠকের পর শিক্ষামন্ত্রী ফের আলোচনায় বসতে শিক্ষার্থীদের আহবান জানান।

২২ জানুয়ারি দিবাগত মধ্যরাতে শাবির আন্দোলনরতদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মাধ্যমে কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি আন্দোলন থেকে সরে এসে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে জোর দেন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর দ্বিতীয়বারের অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করেন শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি রাত পৌনে ৮টার দিকে শাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বাসভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে বিকাল থেকে তাঁর বাসা ঘেরাও করা হয়। পরদিন (২৫ জানুয়ারি) রাতে বিদ্যুৎ সংযোগ পুনরায় প্রদান করা হয়।
এদিকে, শাবিপ্রবি’র ছাত্র আন্দোলনে অর্থ জোগান দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক ৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এ ৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি দল। পরে মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) বিকেলে তাদের সিলেট নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন- টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর দারিপাকা গ্রামের মতিয়ার রহমান খানের ছেলে হাবিবুর রহমান খান (২৬), বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ থানাধীন লক্ষ্মীকোলা গ্রামের মুইন উদ্দিনের ছেলে রেজা নুর মুইন (৩১), খুলনা জেলার সোনাডাঙ্গার মিজানুর রহমানের ছেলে এএফএম নাজমুল সাকিব (৩২), ঢাকা মিরপুরের মাজার রোডের জব্বার হাউসিং বি-ব্লকের ১৭/৩ বাসার এ কে এম মোশাররফের ছেলে এ কে এম মারুফ হোসেন (২৭) ও কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানাধীন নিয়ামতপুর গ্রামের সাদিকুল ইসলামের ছেলে ফয়সল আহমেদ (২৭)।

এর মধ্যে হাবিবুর শাবির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে ২০১২ সালে পাস করেছেন। একই বছর আর্কিটেকচার বিভাগ থেকে পাস করেছেন রেজা নূর মঈন দীপ ও নাজমুস সাকিব দ্বীপ।
জিজ্ঞাসাবাদের পর মঙ্গলবার রাতে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) জালালাবাদ থানায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।

অপরদিকে, আন্দোলনের ১২ তম দিন (মঙ্গলবার- ২৫ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় শাবিপ্রবির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কিছুটা পিছু হটতে দেখা যায়। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে অনশনকারীদের পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙানোর চেষ্টা চালান আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের একাংশ। তবে কয়েকজন অনশনকারী পানি পান করতে রাজি না হওয়ায় তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসেন। প্রায় ৩ ঘণ্টা আলোচনার পর গণমাধ্যমকে তারা অনশন না ভাঙা এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানান।

মঙ্গলবার রাতের প্রেস ব্রিফিংয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র শাহরিয়ার আবেদিন সাংবাদিকদের জানান, ওই সময় পর্যন্ত তাদের ২৮ শিক্ষার্থী আমরণ অনশনে রয়েছেন। অনশন কর্মসূচি শুরুর পর দেড় শ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময় অনশনরতদের মধ্য থেকে বিভিন্ন সময়ে ১৬ জন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অনশনের শুরুর দিন থেকে কয়েকটি মেডিকেল টিমের স্বাস্থ্যসেবা মিললেও মঙ্গলবার সকাল থেকে সে সেবা আর মিলেনি।
পরে মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাত ৩টা ৫৫ মিনিটে ক্যাম্পাসে আসেন শাবির সাবেক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী (সাবেক অধ্যাপক) ড. ইয়াসমিন হক। তাদের অনুরোধে অবশেষে অনশন ভাঙতে রাজি হন শিক্ষার্থীরা।

 

আরো সংবাদ পড়ুন
© All rights reserved © 2021 Anushondhan News
Developed by Host for Domain