অনুসন্ধান নিউজ :: রোজা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম স্তম্ভ। তাই রোজা রাখা প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমানদের জন্য অবশ্যই করণীয়। বেশির ভাগ ডায়াবেটিস রোগীরা রোজা রেখে থাকেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারা বিশ্বের ৫০ মিলিয়ন এর বেশী ডায়াবেটিস রোগী রোজা রাখেন, কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে যারা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া রোজা রাখেন তারা বেশ কিছু জটিলতার সম্মুখীন হন, বিশেষ করে (১) রক্তে সুগারের স্বল্পতা (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) (২) রক্তে সুগারের আধিক্য (হাইপারগ্লাইসেমিয়া) (৩) ডায়াবেটিক কিটো ও এসিডোসিস এবং (৪) পানি শুন্যতা বা ডিহাইড্রেসনে ভোগেন।
যে সমস্ত রোগী শুধু মাত্র খাবার ও ব্যায়াম এর মাধ্যমে তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখেন, তাদের রোজার দ্বারা সৃষ্ট জটিলতা কম। যারা মেটফরমিন, গ্লিটাজোনস কিংবা ইনক্রিটিন জাতীয় ওষুধ খান তাদের ও এ সময় হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম। তবে যারা সালফোনাইলইউরিয়া এবং ইনসুলিন গ্রহণ করন, তাদের ঝুঁকি কিছুটা হলে ও থাকে। অবশ্য ওষুধ এবং ইনসুলিন এর ধরণ অনুযায়ী এর তারতম্য হয়।
ডায়াবেটিস রোগী রোজা রাখতে পারবেন। যাদের সামর্থ আছে তাদের ডায়াবেটিস এমন কোন বাধা নয়। প্রয়োজন পূর্ব প্রস্তুতি। ডায়াবেটিস রোগীরা রমজানের কমপক্ষে ২-৩ মাস পূর্বে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রস্তুতি নেবেন। দেশ বিদেশের একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে রমজানের পূর্বে প্রস্তুতি নিয়ে যারা রোজা রাখেন তাদের হাইপো সহ অন্য জটিলতা রমজানের পূর্বের চেয়েও অনেক কম। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি সহজে এবং নিরাপদে রোজা রাখার সুযোগ করে দিয়েছে।
রোজা মানুষ কে সুশৃঙ্খল জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করে। সুশৃঙ্খল জীবন ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অপরিহার্য। ডায়াবেটিস রোগীরা রোজা রাখার আকাঙ্খা নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে আগে থেকে পরামর্শ করে সুগার কন্ট্রোল করে রাখলে রোজা রাখতে আরো বেশী সুবিধা হবে। সুতরাং এ কথা বলা অত্যুক্তি হবেনা যে, রোজা রাখার আকাঙ্খা ডায়াবেটিস রোগীর ডায়াবেটিস কন্ট্রোল এর ব্যাপারে আরো বেশি উদ্যোগী করবে।
রমজানের পূর্ব প্রস্তুতি
ক্স রমজানের ফরজ রোজা কে সঠিক ভাবে আদায়ের জন্য রোজার ২-৩ মাস আগে থেকে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে রোজার প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন।
ক্স ডাক্তার আপনাকে রোজার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাগুলো এবং এর উত্তরণের উপায়গুলো শিক্ষা দিবেন।
ক্স হাইপো না হওয়ার জন্য খাদ্য, ব্যায়াম এবং ওষুধের সমন্বয় করে দিবেন।
ক্স দিনে রাতে সুগার পরিমাপ করে ওষুধ সমন্বয়ের ব্যাপারে রোগী ও রোগীর পরিবার সকল কে শিক্ষা প্রদান করবেন।
ক্স প্রত্যেক রোগীর জন্য একই ব্যবস্থা প্রয়োজ্য নহে। রোগীর অবস্থা অনুযায়ী আলাদা আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ক্স ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে ৩ বারের ওষুধ ১ বার বা ২ বারে পরিবর্তন করে নিতে হবে।
ক্স রমজানের পূর্বে থেকে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে দুপুরের ওষুধ রাতে খাওয়া শুরু করতে পারেন।
ক্স রমজানের পূর্বে নফল রোজা রেখে প্রস্তুতি নেয়া ভাল।
রোজায় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া
(হাইপোগ্লাইসেমিয়া)
কারণ সমূহ:
রোজায় দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা, যে কারণে দিনের শেষ ভাগে বড় ধরণের দুর্ঘটনার সম্ভাবনার সৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া অন্য যে কোন অতিরিক্ত কাজ করা দ্বারা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যেতে পারে, যেমন: বড় ধরণের শারীরিক বা কায়িক পরিশ্রম রক্তের গ্লুকোজের বড় একটা অংশ কমিয়ে দেয়। অতিরিক্ত ইনসুলিন অথবা ট্যাবলেট গ্রহণ করায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ইনসুলিন ও সিরিঞ্জ একই মাপের না হলে, বরাদ্দের চেয়ে খাবার খুব কম খেলে বা খাবার খেতে ভুলে গেলে।
হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ গুলো নিম্নরূপঃ
ক) অসুস্থ বোধ করাখ) খিদে বেশি পাওয়া
গ) বুক ধড় ফড় করাঘ) বেশী ঘাম হওয়া
ঙ) শরীর কাঁপতে থাকাচ) শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা
ছ) চোখ ঝাপসা হয়ে আসাজ) অস্বাভাবিক আচরণ করা
ঝ) অজ্ঞান হয়ে যাওয়াঞ) খিঁচুনী হওয়া।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে কি করা উচিত?
রোজাদার ব্যক্তির উপরি উক্ত লক্ষণ দেখা দিলে অথবা রক্তের সুগারের পরিমাণ ৭০ মি: গ্রা: (৩.৯ মি: মোল) এর নিচে হলে রোজা ভেঙ্গে ফেলতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে কাযা আদায় করতে হবে। হাইপোগ্লাইসেমিয়া একটি মেডিকেল ইমারজেন্সি। রোগীকে সাথে সাথে চা চামচের ৪ থেকে ৬ চামচ গ্লুকোজ বা চিনি এক গ্লাস পানিতে গুলে খাওয়াতে হবে। গ্লুকোজ বা চিনি না থাকলে যে কোন খাবার সাথে সাথে দিতে হবে। রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে মুখে কিছ ুখাওয়াবার চেষ্টা না করে গ্লুকোজ ইনজেকশন দিতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
রমজানে ডায়াবেটিস রোগীগণের খাবার
সঠিক সময়ে ইফতার করা। ইফতারিতে অতিরিক্ত মিষ্টি এবং চিনি জাতীয় খাবার গ্রহণ না করা। ভাজা পোড়া কম খাওয়া।
ইফতারে এবং রাতের বেলা পর্যাপ্ত পানি, তরল খাবার এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। ইফতারে অতি ভোজন পরিহার করতে হবে। ১-২টা খেজুর খেতে পারবে।
পূর্ব নির্ধারিত ক্যালরি ঠিক রেখে খাবারের ধরণ ও পরিমাণ সমন্বয় করে নিতে হবে। খাবারের সঠিক ‘সময়’ এবং ‘পরিমাণ’ যেন ঠিক থাকে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
সেহ্রির খাবার সেহ্রির সময় শেষ হবার অল্প কিছুক্ষণ আগে খাওয়া ভাল। সেহ্রির সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ খেতে হবে। প্রতিবার খাবারে সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে।
পরবর্তী পাতায় কিছু নমুনা খাবার দেয়া হল। লক্ষ্য রাখতেহবে ঔষধের সঙ্গে যেন সামঞ্জস্য থাকে।
রোজার সময় খাবারের নমুনা তালিকা
(ক্যালরি ১৬০০)
ইফতার
বুট ভুনা
১/২ কাপ (২৫ গ্রাম কাঁচা বুট)
পিঁয়াজু
২ টা বড় মাপের (২৫ গ্রাম ডাল)
বেগুনী
২ টা বড় মাপের (১০ গ্রাম বেশন)
মিষ্টি ফল
যে কোন একটি
শশা, ক্ষীরা, আমড়া, কাঁচা পেয়ারা, কচি ডাবের পানি, লেবুর পানি (চিনি ছাড়া) ও অন্যান্য টক ফল ইচ্ছামত খাওয়া যাবে।
সন্ধ্যা রাত
আটার রুটি
৯০ গ্রাম (৩টা ছোট পাতলা) বা ভাত ২.৫ কাপ
মাছ বা মাংস
১-২ টুকরা
ডাল/দুধ
১.৫ কাপ মাঝারি ঘন বা দুধ ১ কাপ (সর ছাড়া)
সবজি
ইচ্ছামত
সেহ্রী
ভাত
২.৫ কাপ (৩০০ গ্রাম)
মাছ বা মাংস
১-২ টুকরা
ডাল/দুধ
১.৫ কাপ মাঝারি ঘন বা দুধ ১ কাপ (সর ছাড়া)
সবজি
ইচ্ছামত
বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন
ক্স রমজান মাস রহমত, বরকত, মাগফিরাত এবং নাজাতের মাস।
ক্স রমজান আত্বশুদ্ধির এবং আত্মপোলব্ধির মাস।
ক্স রমজানের সুশৃঙ্খল জীবন যাপন এবং ইবাদত বন্দেগী ডায়াবেটিস রোগীদের ওজন এবং সুগার কমাতে সহায়তা করে।
ক্স ডায়াবেটিস রোগীরা রোজা রাখতে পারবেন। তবে ২-৩ মাস আগে থেকে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রস্তুতি নিতে হবে।
ক্স রোজার সময় নিজে ডায়াবেটিসের ওষুধ সমন্বয় করবেন না, এতে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে।
ক্স রোজার সময় দিনে এবং রাতে সুগার মাপা উচিত, ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, এতে রোজার কোন ক্ষতি হয়না।
ক্স সেহ্রীর খাবার সেহ্রীর শেষ সময়ের কিছু আগে খাওয়া উচিত। ইফতারের সময় বেশি চিনিযুক্ত খাবার খাবেন না।
ক্স রোজার সময় দিনের বেলা অতিরিক্ত ব্যায়াম করা উচিত নয়। এতে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। হাইপো হলে রোজা ভেঙ্গে খেয়ে নিবেন। পরে কাযা আদায় করবেন।
ক্স রোজার সময় রাতের বেলা পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি (সম্ভব হলে ডাবের পানি), কম মিষ্টি রসালো ফল এবং পুষ্টি কর খাবার খাওয়া উচিত।
ক্স ডয়াবেটিস রোগীদের সার্বিক কল্যাণের জন্য আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব এবং প্রচার মাধ্যম গুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
অধ্যাপক ডা: মো: ফরিদ উদ্দিন
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান
এন্ডোক্রাইনোলজি (ডায়াবেটিস ও হরমোন) বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
শাহবাগ, ঢাকা।