অনুসন্ধান নিউজ :: সিলেট অঞ্চলে বন্যার কারণে বহু শিক্ষার্থীর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। বই-খাতা পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের বিকল্প বই দেবে প্রশাসনের সে সুযোগও নেই। কারণ তাদের গুদামেও নেই পর্যাপ্ত বই।
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন স্বল্প আয়ের পরিবারের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা। পরীক্ষা আপাতত স্থগিত হলেও তারিখ দিলে পড়ার মতো বই কোথায় পাবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় সবাই।
সিলেট সদর উপজেলার সালুটিকর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে তোফাজ্জল হোসেন। তার বইও ভেসে গেছে বানের জলে।
তোফাজ্জল বলে, ‘বন্যার কারণে কয়েক দিন ধরেই পড়ালেখা করতে পারছি না। পরিবারের সবার সঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম। এখন বাড়িতে এসে দেখি ঘরে বই-খাতা, জ্যামিতি বক্স কিছুই নেই। সব পানিতে ভেসে গেছে। যেকোনো দিন পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হবে। এখন আমি বই-খাতা পাব কোথায়?’
রায়েরগাঁও এলাকার বাসিন্দা শিহাব আহমদ রাজারগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। গত ১৭ জুন পানি ঢুকে পড়ে শিহাবদের ঘরে। বন্যার পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে তার সব বই-খাতা।
ভেসে গেছে বই, অনিশ্চিত পড়ালেখা
শিহাব বলে, ‘হঠাৎ করে পানি ঢুকে পড়ায় বই-খাতা সরাতে পারিনি। আমরা একটা আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম। শুক্রবার আশ্রয়কেন্দ্র থেকে এসে দেখি সব বই-খাতা ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। বেশির ভাগ ছিঁড়ে ভেসে গেছে পানিতে।’
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে কোনো রকমে দিন কাটছে শিহাবদের। তার কৃষক বাবা আব্দুল করিমের আয়ের উপায় এখন বন্ধ। পানি নেমে গেলে ঘর ঠিকঠাক করার পাশাপাশি চাষের জন্য পয়সা জোগাড় করাই এখন ভীষণ চ্যালেঞ্জ তার জন্য। বাড়তি চাপ হয়ে দেখা দিয়েছে ছেলের বই-খাতা।
করিম বলেন, ‘এখন খাওয়া থাকা নিয়েই চিন্তায় আছি। বাচ্চার বই-খাতা কিনব কী করে? আবার সরকার থেকে দেয়া বিনা মূল্যের বইগুলো তো বাজারে কিনতেও পাওয়া যাবে না।’
সিলেটে গত ১৫ জুন থেকে বন্যা শুরু হয়। স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যায় প্লাবিত হয় জেলার ৮০ শতাংশ এলাকা। ২১ লাখেরও অধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ২৯ হাজার ঘরবাড়ি। পানি কমতে শুরু করলেও এখনও প্লাবিত রয়েছে জেলার বেশির ভাগ এলাকা।
বন্যায় শিহাব, তোফাজ্জলের মতো অনেক শিক্ষার্থীই হারিয়ে ফেলেছে বই-খাতাসহ শিক্ষা সরঞ্জাম। এতে শিক্ষাজীবন নিয়ে চিন্তায় পড়েছে শিক্ষার্থীরা। বিশেষত দরিদ্র পরিবারগুলোর শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে। সরকার থেকে দেয়া পাঠ্যবই বাজারে কিনতে পাওয়া না যাওয়ায় এগুলো হারিয়ে সংকটে পড়েছে সব শিক্ষার্থী। তাদের বইসহ শিক্ষা সরঞ্জাম দেয়া না হলে এই সমস্যার সমাধান কঠিন।
তবে বন্যায় কী পরিমাণ শিক্ষার্থীর ক্ষতি হয়েছে, সেটির তথ্য নেই শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে।
বিতরণযোগ্য বই নেই শিক্ষা বিভাগে
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক আব্দুল মান্নান খান বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করার জন্য আমরা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি। এ ছাড়া যে যে এলাকা উদ্বৃত্ত বই রয়েছে তা সংগ্রহ করে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রদানের ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’
তবে এটি যে সমাধান নয়, সেটি তার বক্তব্যেই স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘এবার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। সুনামগঞ্জ তো পুরাটাই ক্ষতিগ্রস্ত। সিলেটেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ কারণে উদ্বৃত্ত বইয়ে হবে না। আবার নতুন করে এখন বই ছাপানোও কঠিন। তাই ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের আমরা অনুরোধ করব, সম্ভব হলে তারা যেন সহপাঠীদের কাছ থেকে বই ম্যানেজ করে নেয়ার চেষ্টা করে।’
শিক্ষা অফিসের গুদামে থাকা বইও পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে জানিয়ে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা প্রতুল চন্দ্র সরকার বলেন, ‘মজুত থাকা বইয়েরও ৫০ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ক্ষতি পোষাতে ঢাকা থেকে বই পাঠাতে হবে।’
স্কুল খোলার আগে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ জানা যাবে না উল্লেখ করে এই শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘ঈদের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে। তখন ক্ষতির পরিমাণ জেনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চাহিদা পাঠানো হবে।’
ঝরে পড়ার হার বাড়ার শঙ্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক জফির সেতু।
তিনি বলেন, ‘আমি বন্যার শুরু থেকে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে বেড়াচ্ছি। অনেক শিক্ষার্থীই আমাকে জানিয়েছে, তাদের বই-খাতাসহ শিক্ষা সরঞ্জাম পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। বই হারিয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে। কারণ সামনেই তাদের পরীক্ষা।
‘এ ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরই ঝরে পড়ার হার বাড়ে। এখন সরকার যদি ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের বইসহ শিক্ষা সরঞ্জাম প্রদানের উদ্যোগ না নেয়, তবে ঝরে পড়ার হার আরও বাড়বে। বন্যায় সব হারিয়ে দরিদ্র পরিবারগুলো এমননিতেই সংকটে। বই-খাতা কেনার মতো অর্থ তাদের কাছে নেই।’
ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকাই নেইশিক্ষার্থীদের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা এখনও পাওয়া যায়নি জানিয়ে গোলাপগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অভিজিৎ কুমার পাল বলেন, ‘স্কুল খোলার আগে এ ধরনের তথ্য পাওয়া যাবে না।’
জেলা প্রথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাখাওয়াত এরশাদ বলেন, ‘আমরা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তালিকা করছি। স্কুল ভবনের কেমন ক্ষতি হয়েছে, শিক্ষার্থীদের বই-খাতা কী পরিমাণ নষ্ট হয়েছে, সেগুলোর তালিকা করছি। কিন্তু অনেক জায়গা থেকে এখনও পানি নামেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও জানা যায়নি।’