অনুসন্ধান ডেস্ক :: সুনামগঞ্জে হাওরে সরকারিভাবে ইজারা দেওয়া জলমহালে মাছ লুটপাট থামছে না। দিনে-দুপুরে আনন্দ-উল্লাসে প্রকাশ্যে এর আগে ৫ দিনে দিরাই ও শাল্লা উপজেলার ৭ টি জলমহালের কয়েক কোটি টাকার মাছ লুট করার পর বুধবারও দিরাই ও জামালগঞ্জ উপজেলার আরও চারটি জলমহালের প্রায় দুই কোটি টাকার মাছ লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে।
জলমহালের ইজারাদাররা জানিয়েছেন, আনন্দ-উল্লাসে হাজার হাজার মানুষ মিলে জলমহালের (বিল বা নদী) মাছ লুট থামছে না। পূর্ব ঘোষণা দিয়ে মাছ লুটপাট করা হলেও আইনশৃংখলা বাহিনীকে জানিয়ে আটকানো যায়নি। হাজার হাজার মানুষের কাছে অসহায় ছিল স্থানীয় প্রশাসন। যদিও সুনামগঞ্জের অতিরিক্তি পুলিশ সুপার (মিডডিয়া) জানিয়েছেন, এসব ঘটনার জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয় লোকজন ও বিলের ইজারাদার জানিয়েছেন, বুধবার ভোরে জামালগঞ্জ উপজেলার নাজিমনগর, হাটামারা, দিরাই উপজেলার সিচনি, রফিনগর, মির্জাপুর, বাংলাবাজার ও খাগাউরাসহ আশপাশের গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ জামালগঞ্জ উপজেলার হটামারা গ্রামের কাছের আয়লা-ছাগাইয়া বিলে ঢুকে পলো, বিভিন্ন ধরনের জাল ও কুচা দিয়ে প্রায় কোটি টাকার মাছ ধরে নেয়।
এদিকে, বুধবার সকালে দিরাই উপজেলার ধনপুর, চন্দ্রপুর, ভাঙাডহর, বাউশি, সরমঙ্গল, চিতলা, গাঘটিয়া, চরনারচর, ঝাইল্লা, আছিমপুর, কাইলানী গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ উপজেলা সদরের পাশের ভরারগাঁও গ্রামের পূর্বপাশের বেতইর নদীর ভরারগাঁও-ঘুফরাঘাট ও বেতইর নদী-সেখামপুর অংশের দুটি জলমহালের মাছ জোর করে ধরে নেয়। এর আগে একই উপজেলার কেজাউরা গ্রামের পাশের বড় মেদী বিলের মাছ লুট করে নেয় কয়েক হাজার মানুষ।
আগাম খবর পেয়ে তিনটি জলমহাল রক্ষা করতে ভোরেই দিরাই উপজেলা নির্বার্হী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি), থানার ওসি, স্থানীয় সেনাক্যাম্পের সদস্য ও আনসার সদস্যরা উপস্থিত হলেও পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে তা ঠেকাতে ব্যর্থ হন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দিরাইয়ের একটি বড় বিলের ইজারাদারের ব্যবসায়িক অংশিদার বললেন,‘ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিচ্ছে একটি মহল। সাধারণ মানুষকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে বিশাল বিশাল মাছ ধরার লোভ দেখিয়ে গণহারে জলমহালের মাছ লুটপাট করছে। অনেকেই লুটের মাছ বাজারে বিক্রি করছে। এমন লুটপাটের ঘটনায় ক্ষতির মুখে পড়বে জলমহাল ব্যবসা ও সংশ্লিষ্টরা। ’
জামালগঞ্জের আয়লা ছাগাইয়া বিলের ইজাদার নবীনগর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির লি এর সাধারণ সম্পাদক প্রীতুস বর্মণ বলেন,‘ হটাৎ করে গতকাল বুধবার ভোরে জলমহালের আশপাশের দুই উপজেলার ৮-১০ গ্রামের হাজার হাজার মানুষ জোর করে বিলে ঢুকে পড়ে। এসময় পাহারাদাররা ভয়ে দূরে সরে যায়। পলো, বিভিন্ন ধরনের জাল ও কুচা দিয়ে প্রায় কোটি টাকার মাছ ধরে নিয়ে গেছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে লিখিতভাবে জানিয়েছি।’
বেতইর নদীর ভরারগাঁও-ঘুফরাঘাট জলমহালে ইজারাদার কচুয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির লি. এর সভাপতি লংকেশ্বর দাস খোকা জানান, এই বছর বিলটি পাইল (জলমহালে বাঁশ-কাঠা দিয়ে মাছের অভয়ারন্য সৃষ্টি করে মাছের পরিচর্যা করা হচ্ছিল) কিন্তু হটাৎ করে শুনি লুটপাট করা হবে। খবর পাওয়ার পরপরই আমরা ওসি, ইউএনও স্যারকে জানাই। তারা গতকাল ভোরে পুলিশ ও আর্মি নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু হাজার হাজার মানুষকে আটকানো সম্ভব হয়নি। আমাদের প্রায় ৭০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, ক্ষতির প্রায় কোটি টাকা হবে। আমরা এখন কি করব, কার কাছে বিচার চাইব।
জামালগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম বলেন,‘ ভান্ডা বিলের ইজারাদার আশংকার কথা জানিয়ে থানায় এসছিলেন, আমরা সেখানে পুলিশ পাঠিয়েছিলাম। তবে হটামারা গ্রামের কাছে আয়লা-ছাগাইয়া জলমহালে জোর করে মাছ ধরার বিষয়ে ইজারাদার বা অন্য কেউ আমাদের জানায় নি। ’
দিরাই উপজেলা নিবার্হী সন্জিব সরকার বললেন,‘ খবর পেয়ে আমরা বুধবার ভোর থেকেই সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসার নিয়ে তিনটি বিলের মাছ রক্ষার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার চেষ্টার পরও আমরা ব্যর্থ হয়েছি। হাজার হাজার মানুষ মাছ ধরতে জাল ও প্রাণঘাতি ধারালো অনেক কিছু নিয়ে এসেছিল। এক পর্যায়ে কিছু লোক আমাদের উপর আক্রমন করার চেষ্টা করে। পরে বাধ্য হয়ে আমরা সরে আসি। তিনটি বিলের মাঠ লুটের ঘটনায় সংশ্লিষ্টরা লিখিত অভিযোগ দিবেন বলে জানিয়েছেন। ’
অতিরিক্তি পুলিশ সুপার মো. জাকির হোসেন (মিডিয়া) বলেছেন,‘ দিরাই ও শাল্লার জলমহালের মাছ ধরার বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। যারা ইজারার সাথে জড়িত তাদের সাথে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, ‘জলমহাল থেকে জোর করে মাছ ধরার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে।’