অনুসন্ধান ডেস্ক ::: উত্তাল সমুদ্র। দুই মিটার উঁচু হয়ে উঠছে আর নামছে। ভারি বর্ষণ। আকাশে বজ্রপাত। তীব্র বাতাসের মাতামাতি। এমন পরিস্থিতিতে কোনো জাহাজের নাবিক, ক্রুদের প্রাণ থাকে হাতের মুঠোয়। কারণ, যেকোনো সময় ডুবে যেতে পারে বাহন। প্রতিকূল সমুদ্রের এমন উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যে জীবনের দিকে না তাকিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নামের ছোট ছোট জাহাজ। ঢেউয়ের দোলায় কলার খোসার মতো দুলছে তা। লাইফ জ্যাকেট পরে প্রস্তুত আরোহীরা। আছে যেকোনো সময় ইসরাইলি সেনাদের ড্রোন হামলার ভয়। সাবমেরিন থেকে বোমা মেরে আকাশে ছুড়ে মারতে পারে পুরো ফ্লোটিলাকে। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে পারে তাতে ফ্লোটিলা ও এর আরোহীরা। হ্যাঁ, যে ইসরাইল সারাবিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে গণহত্যায় মেতেছে, তারা এটা করতে পারে। কারণ, তারা জানে বিশ্বে এমন কোনো শক্তি নেই, যে বা যারা তার কোনো ক্ষতি করতে পারে। অথবা তার কাজে বাধা দেবে- হোক সেটা বৈধ বা অবৈধ। সে খুব ভাল করেই জানে গাজায় মুসলিমদের গণহত্যা চালানো হচ্ছে, আর তা বাকি বিশ্ব বসে বসে দেখছে। যেমনটা কোনো শিশুর হাতে নোলা ধরিয়ে দিয়ে যেকোনো কাজ করা যায়। সারাবিশ্বের বিবেক যখন অচল হয়ে গেছে, বিকল হয়ে গেছে, গাজা ইস্যুতে তারা বোবা হয়ে যায়- তখন গাজায় গণহত্যার শিকার, অনাহারে অভুক্ত মানুষদের বাঁচানোর প্রতীকী অভিযান হিসেবে চালু করা হয় গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। তারা গাজার বিরুদ্ধে ইসরাইলি অবরোধ ভাঙার প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা শুরু করে স্পেনের বার্সেলোনা থেকে। এতে রয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ৫০০ মানবাধিকারকর্মী। আমাদের গর্বের বিষয় এর মধ্যে আছেন বাংলাদেশের পতাকা বহনকারী মানবাধিকারকর্মী, লেখক, সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার শহিদুল আলম। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আরেকজন। তিনি বৃটিশ বাংলাদেশি রুহি লরেন আখতার। এই দু’জনেই বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের নামকে আরেকবার জানান দিয়ে দিলেন। বাংলাদেশের আঠার কোটি মানুষের প্রার্থনা এখন তাদের সঙ্গে। কারণ, তারা সেখানে রাজনীতি করতে যাননি। গিয়েছেন মানবতার ডাকে। সেই ডাকে বাংলাদেশের নামকে উজ্বল করেছেন তারা।
এরই মধ্যে আলোচনা হচ্ছে, মানবাধিকারকর্মীদের এই মিশন এটাই প্রমাণ করে যে, বিশ্বনেতারা ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, এমন কোনো অভিযান কোনো দেশের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। গাজা ও ইসরাইলের চারপাশে ঘিরে আছে মুসলিম দেশগুলো। তারা দৃশ্যত ভয়ে জবুথবু নাহয় তারা নিজেদের স্বার্থের কারণে চুপচাপ দেখছে গণহত্যা। কিন্তু যে বাঘে কোনো গ্রামের একজনকে খেয়ে ফেলে, সেই গ্রামের কেউই নিরাপদ থাকে না, তারা হয়তো সে কথা বুঝতে পারছেন না। ইসরাইল এরই মধ্যে সম্প্রসারণবাদের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। তারা জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন সহ আশপাশের কয়েকটি দেশকে দখল করে বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। যখন বাঘের মতো এসব দেশকে ধরবে ইসরাইল, তখনও হয়তো বিস্ফারিত চোখে তারা তাকিয়ে থাকবে অথবা আত্মসমর্পণ করবে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘে কমপক্ষে ১৪৭টি দেশ সমর্থন দিলেও ইসরাইল বলেছে, ফিলিস্তিন নামে কোনো রাষ্ট্র হবে না। জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করলেও, তিনি নির্বিঘ্নে যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো সফর করছেন। তাহলে জাতিসংঘের বা এর সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদা থাকলো কোথায়? এর মধ্য দিয়ে জাতিসংঘকে কি পিষ্ট করছে না ইসরাইল? বিশ্ব যেখানে চুপ, সেখানে সাহস দেখাচ্ছেন শহিদুল আলম, রুহি লরেন আখতার, গ্রেটা থানবার্গ, এমা ফেরো সহ প্রায় ৫০০ অধিকারকর্মী। এর মধ্যে গ্রেটা থানবার্গ মাত্র ১৫ বছর বয়সে মানবাধিকার কর্মীতে পরিণত হন। আর শহিদুল আলম তো বাংলাদেশের আলোচিত অধিকারকর্মী। তিনি এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের পারসন অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হয়েছেন। ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে মানবিক যেকোনো আন্দোলনে তিনি ঢাকার রাজপথে থেকেছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন। ক্ষমতাসীনদের তখ্ত নাড়িয়ে দিয়েছেন। শুধু দেশের পরিমণ্ডলেই নয়, তিনি এবার বিশ্ব পরিমণ্ডলেও মানবতার ডাক ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সঙ্গে আছেন বাংলাদেশি বৃটিশ রুহি আখতার। তিনি বাংলাদেশের সিলেটি পিতামাতার সন্তান। সম্প্রতি হাইপেন অনলাইন তার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, শৈশবেই রুহি লরেন আখতার চারপাশের বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। অন্যদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা তখন থেকেই জন্ম নেয়। উত্তর নর্দাম্বারল্যান্ডের মরপেথে জন্ম নেয়া রুহি আখতার বাংলাদেশি অভিভাবকের সন্তান। কৈশোরে এক বছর বাংলাদেশে কাটানোর পর তিনি আবার বৃটেনে ফিরে যান এবং এনএইচএস-এ ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে, তিন বছরের সিরীয় শিশু আলান কুর্দির সমুদ্রপথে গ্রিসে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ডুবে মৃত্যুর হৃদয়বিদারক ছবি যখন বিশ্বকে নাড়া দেয়, তখন রুহি আখতার উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ক্যালে এবং ডানকার্ক শিবিরে সাহায্য করতে যান। সেই বছরই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রিফিউজি বিরিয়ানি অ্যান্ড বানানাস (আরবিবি) নামের একটি মানবিক উদ্যোগ, যা যুদ্ধ ও সংঘাত থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের খাদ্য, জরুরি স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সামগ্রীসহ জীবনরক্ষাকারী সহায়তা দিয়ে থাকে। পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়ন ও নেতৃত্ব প্রশিক্ষণও দেয়।
বর্তমানে সংগঠনটি গাজা ও গ্রিসে কাজ করছে। গত বছর অক্টোবরে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে রুহি আখতারকে নর্থ ইস্ট বাংলাদেশি অ্যাওয়ার্ডসে পারসন অব দ্য ইয়ার হিসেবে সম্মাননা দেয়া হয়, বাস্তুচ্যুত সম্প্রদায়ের সেবায় তার অসাধারণ অবদানের জন্য। তিনি হাইফেন পত্রিকায় কথা বলেছেন গাজায় আরবিবির কাজ, একজন মুসলিম নারী হিসেবে মানবিক খাতে কাজের চ্যালেঞ্জ এবং তার অনুপ্রেরণা নিয়ে। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, শুরুতে আমি নর্থাম্বারল্যান্ডের স্থানীয় কিছু গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হই। তারা সিরিয়ার জন্য সাহায্য সংগ্রহ করছিল। এরা ক্যালে এবং ডানকার্কেও কাজ করত। তাই আমি নিজে গিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি দেখতে চাইলাম। আমি ভীষণ অবাক হয়ে যাই-পুরুষ, নারী, শিশু সবাই আধুনিক ইউরোপে খোলা আকাশের নিচে তাঁবুতে বসবাস করছে। একদিকে মাত্র সমুদ্রপারের বৃটেন, আরেকদিকে যুদ্ধ থেকে পালানো মানুষগুলো ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে তাঁবু বা পোকামাকড় আর ইঁদুরে ভরা কন্টেইনারে। আমি জানতাম, আমি এসব দেখে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারব না। ডানকার্কে কাজ করার সময় অনেকেই বুঝল আমি দক্ষিণ এশিয়ান। সেখানে প্রচুর আফগান ও পাকিস্তানি ছিল, তাই প্রথমে ক্রিকেট নিয়ে আলাপ শুরু হলো। পরে তারা বলল, শিবিরে তাদের যে খাবার দেয়া হয় তা প্রায়ই নষ্ট বা পচা থাকে, অনেক সময় সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না। তাদের সবচেয়ে বড় ইচ্ছে ছিল একটা ঘরে তৈরি খাবার পাওয়া। তখন আমার মাথায় এলো- ‘সবাইকে কেন বিরিয়ানি খাওয়ানো যাবে না?’ আমি অনলাইনে পোস্ট দিলাম, যা ভাইরাল হয়ে গেল। ইউরোপজুড়ে মানুষ সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। আমরা ২০০০ পাউন্ড তুললাম হালাল মাংস কেনার জন্য। সৌভাগ্যক্রমে তখন সেখানে একটা অস্থায়ী রান্নাঘর ছিল, যেটা ব্যবহার করে আমরা খাবার রান্না ও বিতরণ করতে পারলাম। এটি বিশাল এক উদ্যোগ ছিল। শুধু একবারের বিরিয়ানি মিশনে আমরা ডানকার্ক ক্যাম্পে ২৫০০ জনকে খাওয়াতে পেরেছিলাম। এভাবেই আমাদের নাম হলো রিফিউজি বিরিয়ানি অ্যান্ড বানানাস। মূলত এটি কখনো সংগঠন হওয়ার কথা ছিল না, আমি যেন হঠাৎ করেই এক সিইও হয়ে গেলাম। মানবিক খাতে বৈচিত্রের ঘাটতি আছে। মুসলিম নারী বা রঙিন নারী খুব কম। আমি গ্রিসের মতো জায়গায় বর্ণবাদেরও শিকার হয়েছি। সাহায্য করতে যাওয়া সত্ত্বেও অনেক সময় সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। আমাকে সীমান্তে বহুবার থামানো হয়েছে, এমনকি পুলিশের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, ভেবে যে আমার পাসপোর্ট নকল। আমাদের কণ্ঠকে সবসময় আরও জোরালো করতে হয়। কিন্তু আমরা আমাদের অবস্থানে অটল থাকি, কারণ আমরা যাদের জন্য কাজ করি তাদের জন্য আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতেই হবে। আমাদের টিম খুবই বৈচিত্র্যময়। ৮০ শতাংশ সদস্যই বাস্তুচ্যুত সম্প্রদায় থেকে আসা, ১০টি দেশ ও বিভিন্ন ভাষার প্রতিনিধিত্ব করছে। আমরা কমিউনিটি হিউম্যানিটারিয়ান লিডারস প্রোগ্রাম চালাই, যেখানে শরণার্থীদের নিয়োগ দিয়ে এনজিও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এতে তারা শুধু সহায়তা গ্রহণকারী নয়, বরং নিজেরাও নেতা হয়ে উঠছে।
আমরা প্রথমে ফেব্রুয়ারিতে কায়রোতে গিয়ে এক ট্রাক সাহায্য পাঠাই গাজায়। সেটা গাজায় পৌঁছেছিল এবং আমাদের টিম বিতরণ করেছিল। মার্চে আবার আরেকটি ট্রাক পাঠাই, সেটিও পৌঁছায়। উভয় ট্রাকেই খাদ্য, ইফতারের জন্য খেজুর এবং স্বাস্থ্যবিধি সামগ্রী ছিল। মে মাসে আরও দুটি ট্রাক পাঠানোর পরিকল্পনা করি। কিন্তু রাফাহ আগ্রাসনের কারণে সীমান্ত বন্ধ হয়ে যায়। সেই ট্রাকগুলো এখনও আল-আরিশে আটকে আছে। এদিকে আমাদের স্থানীয় টিম নিজ উদ্যোগে কিছু সাহায্য কিনে বিতরণ করেছে। নভেম্বর মাসে তারা ৩ লাখ লিটার পানি দক্ষিণ গাজার বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করতে পেরেছে। সত্যি বলতে, এটি আমাদের জীবনে দেখা সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি। সিরিয়া, ইউক্রেন, ইরাক- এসব জায়গায় কাজ করলেও গাজায় সাহায্য পাঠানো সবচেয়ে কঠিন। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে এমনভাবে জটিল করেছে যে মানুষদের কার্যত অনাহারে রাখা হচ্ছে। কিন্তু আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাবই।