অনুসন্ধান নিউজ :: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমদ লিজার পদত্যাগ দাবিতে শুরু হওয়া কর্মসূচি এখন রূপ নিয়েছে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে। এ দাবিতে শিক্ষার্থীরা এখন এতটাই অনড় যে আমরণ অনশন শুরু করেছেন ২৪ জন। শিক্ষকদের আলোচনার সব প্রস্তাবই ফিরিয়ে দিচ্ছেন তারা।
একটি হলের কয়েক ছাত্রীর ছোট আন্দোলন এমন ব্যাপক আকার ধারণ করার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিও অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
শিক্ষক রাজনীতির ইন্ধনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি দ্রুত ঘোলাটে হয়ে ওঠে বলে বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে।
তাদের অভিযোগ, শিক্ষকরা নিজেদের গ্রুপিংয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেছেন। উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে ভুল বুঝিয়েছেন। নিজেরা সুবিধা আদায় করতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দীর্ঘ করতে ইন্ধন দিয়েছেন। যে ঘটনা শুরুতেই সমাধান করা যেত তা জিইয়ে রেখে আন্দোলনকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন।
এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শিক্ষক নেতারা। তাদের দাবি, শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে পুলিশের হামলার ফলে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে; আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর ও ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হিমাদ্রী শেখর রায় বলেন, ‘আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো সংকটে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাই। এখনও আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে এই সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছি।’
কারা সেদিন পুলিশকে শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জের অনুমতি দিয়েছিলেন, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কেউই এ দায় স্বীকার করতে চাচ্ছেন না। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের নির্দেশেই পুলিশ হামলা চালায়।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের তিনটি বলয় রয়েছে। আওয়ামী-বামপন্থি শিক্ষকদের প্যানেল ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষক পরিষদ’। আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদ’ ও বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধে শ্রদ্ধাশীল শিক্ষক পরিষদ’।
শাবির আন্দোলনের অনুঘটক শিক্ষকদের বিরোধ?
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে শিক্ষকদের এই বলয়গুলোর মধ্যে বিরোধ রয়েছে। বিএনপি-জামায়াতপন্থি বলয় এখন অনেকটাই কোণঠাসা। অন্য দুই বলয়ের শিক্ষকরাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও দায়িত্বশীল পদ পাওয়া নিয়ে এই দুই বলয়ের শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব রয়েছে।
এই দ্বন্দ্বের জেরেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে প্রলম্বিত করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন শুরু করার পর প্রকাশ্যে তিন বলয়ের শিক্ষকদেরই একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে। বুধ ও বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন বলয়ের শিক্ষক নেতারাই একসঙ্গে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। তারা একসঙ্গে উপাচার্যের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকও করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদ প্রক্টর ও ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন আওয়ামী-বামপন্থি শিক্ষকদের প্যানেল মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষক পরিষদের দুজন শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন শাখা ও মেডিক্যালের দায়িত্বেও রয়েছেন এই বলয়ের দুজন শিক্ষক। একটি হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বে রয়েছেন এই বলয়ের একজন।
আর আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের প্যানেল মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদের শিক্ষকরা তিন হলের প্রাধ্যক্ষ, রিসার্চ সেন্টার, সেন্টার অফ এক্সিলেন্স, ইনস্টিটিউশন অফ মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজের দায়িত্বে রয়েছে।
সর্বশেষ শিক্ষক সমিতি নির্বাচনে জয় লাভ করে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের প্যানেল ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদ’। সভাপতি-সম্পাদক পদে জয়ী হন তাদের প্যানেলের শিক্ষকরা। এর আগে শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী-বামপন্থি শিক্ষকরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামীপন্থি শিক্ষকরা প্রক্টর ও ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়ার চেষ্টা করছেন, তবে উপাচার্য আগের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষক পরিষদের’ শিক্ষকদের এই দায়িত্ব দেন।
এ নিয়ে দুই বলয়ের শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। এই দ্বন্দ্বের জেরেই ১৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া প্রাধ্যক্ষবিরোধী আন্দোলনকে পুঁজি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করায় ইন্ধন জোগানো হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
তবে শিক্ষকরা এমন কিছু অস্বীকার করেছেন।
শিক্ষক রাজনীতির কারণে পরিস্থিতি ঘোলাটে হওয়ার কথা অস্বীকার করে ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদের নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতা অধ্যাপক তুলসী কুমার দাস বলেন, ‘এ রকম কিছু ছিল বলে আমি মনে করি না। আমার চোখে অন্তত পড়েনি। এগুলো খামাখা ওড়ানো হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রথমে ছোটই ছিল। প্রশাসন হয়তো সমাধানে কিছুটা দেরি করেছে, তবে তারা চেষ্টা করেছে।
‘পুলিশের হামলার পরই পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যায়, তবে আমরা সমাধানের চেষ্টা করছি। তার সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকদের সভাপতি অধ্যাপক মো. আখতারুল ইসলামও এমন কিছু অস্বীকার করে বলেন, ‘সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমেই মূল বিষয় বেরিয়ে আসবে। এখন আমরা এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’