শাবি প্রতিনিধি:: কিছুইতেই থামছে না সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ছাত্র আন্দোলন। বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী হলের প্রভোস্টের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবির আন্দোলন এখন পরিণত হয়েছে উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে।
তৃতীয় দিনের মতো আজ (শনিবার) অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদের পদত্যাগ বা অপসারণ ছাড়া আন্দোলন থেকে সরে না দাঁড়ানোর ঘোষণায় অনড় তারা। আন্দোলনের এ পর্যায়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা কাফনের কাপড় পরে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে মিছিল করেছেন। শনিবার (২২ জানুয়ারি) বিকাল ৩ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্ত্বরে অনুষ্ঠিত এ মিছিলে ৩ শতাধিক আন্দোলনকারী অংশগ্রহণ করেন।
কাফন মিছিলে অংশ নেয়া সাদিয়া আফরিন বলেন, আমাদের এক দফা এক দাবি ‘ভিসি পদত্যাগ’ এর দাবিতে আমরা গত ২০ জানুয়ারি, ২০২২ তারিখ দুপুর ৩টায় ২৪ জন শিক্ষার্থী অনশনে বসি। প্রায় ৭৪ ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হয়নি। তাদের স্বাস্থ্য ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে এবং তারা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা আমাদের সহযোদ্ধাদের কোনোভাবেই একা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারি না। পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন আমাদের এই এক দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলনের মঞ্চ থেকে এক পাও নড়ব না। এই উপাচার্যের জন্য যদি এক জনেরও মৃত্যু হয় তাহলে আমরা সবাই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত আছি।
এদিকে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যর পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশনে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ পর্যন্ত ১৫ জন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অসুস্থদের মধ্যে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তিন শিক্ষার্থী আবারও ক্যাম্পাসে এসে অনশনে যোগ দিয়েছেন। হাসপাতালে এখন চিকিৎসাধীন আছেন ১২ শিক্ষার্থী। তারা সেখানেই অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে গত বুধবার বিকাল থেকে অনশন শুরু করেন ২৪ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে একজনের বাবা হার্ট অ্যাটাক করায় তিনি চলে যান। এখন উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনশনে আছেন ১১ জন। তাদেরও শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। সবার শরীরে স্যালাইন চলছে।
অনশনরত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের একটি দল। এই দলের সদস্য নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘শীতেই বেশি কাতর হয়েছেন অনশনকারীরা। তাদের অনেকের শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। জ্বরও আসছে। এ ছাড়া পানিশূন্যতা দেখা দিয়েছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন লিজার বিরুদ্ধে খাবারের খারাপ মান, অব্যবস্থাপনা ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ আনেন আবাসিক শিক্ষার্থীরা। তার প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে গত ১৩ জানুয়ারি দিবাগত (বৃহস্পতিবার) রাত থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরদিন শুক্রবার সন্ধ্যায় ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে সরে যান। দাবি পূরণ না হওয়ায় শনিবার সন্ধ্যায় ফের বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়ক আটকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। এরপর মধ্যরাতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়ে সরে গেলেও রোববার সকাল থেকে ফের শুরু হয় তাদের বিক্ষোভ। ওই দিন বিকেলে তারা উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদকে অবরুদ্ধ করলে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে। শিক্ষার্থীরাও ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। এরপর শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে কয়েকটি রাবার বুলেট ছোড়া হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা অধ্যাপক জহির উদ্দিন আহমেদ গুলিবিদ্ধ হন। এরপর পুলিশ উপাচার্যকে বের করে তার বাসভবনে নিয়ে যায়। পুলিশ-শিক্ষার্থী সংঘর্ষের পর রোববার অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের সোমবার দুপুর ১২টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। জরুরি সিন্ডিকেট সভা শেষে রোববার রাতে উপাচার্য ফরিদ প্রাধ্যক্ষ জাফরিনের পদত্যাগের বিষয়টি জানান। এরপর থেকেই শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে নামেন।
এর মাঝে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অজ্ঞাতপরিচয় ২ থেকে ৩ শ শিক্ষার্থীকে আসামি করে সোমবার রাতে সিলেটের জালালাবাদ থানায় মামলা করে পুলিশ। মঙ্গলবার বিকেলে এই মামলা প্রত্যাহারের জন্য পুলিশকে সময় বেঁধে দেন শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে উপাচার্যের পদত্যাগের সময় বেঁধে দেন শিক্ষার্থীরা। বুধবার দুপুর ১২টার মধ্যে এ দাবি মানা না হলে আমরণ অনশনে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
শাবি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে সরাতে আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে একাধিকবার তাদের কাছে যান শিক্ষকদের একাংশ। তবে শিক্ষকদের প্রস্তাব তারা প্রত্যাখান করে আন্দোলনে অনড় থাকেন।
এ অবস্থায় শুক্রবার বিকেলে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ঢাকায় এসে আলোচনা করার আহ্বান জানান। শিক্ষার্থীরা প্রথমে রাজি হলেও পরে ঢাকায় যেতে সম্মত হননি। শিক্ষামন্ত্রীকে সিলেটে আসার অথবা ভার্চুয়ালি আলোচনা করার প্রস্তাব দেন শিক্ষার্থীরা। তবে আলোচনা করতে ঢাকায় গেছেন শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দল। শুক্রবার রাতে তারা ঢাকায় যান। শনিবার বিকেলে বা সন্ধ্যায় শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তারা আলোচনায় বসতে পারেন বলে জানা গেছে।
প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে রয়েছেন শাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক তুলসী কুমার দাস। তিনি শনিবার বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে আলোচনায় যেতে শিক্ষামন্ত্রী আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ঢাকায় আসতে রাজি হননি। আমরাই এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ে আমরা উনার (শিক্ষা মন্ত্রীর) সঙ্গে কথা বলব।’
প্রতিনিধি দলে আরও রয়েছেন ফিজিক্যাল সায়েন্সের অনুষদ ডিন অধ্যাপক রাশেদ তালুকদার, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মুহিবুল আলম, অ্যাপ্লাইড সায়েন্স অনুষদের ডিন ডিন অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম, বাণিজ্য অনুষদের ডিন অধ্যাপক খায়েরুল ইসলাম রুবেল।