নিউজ ডেস্ক :: শাহ আলম (৪২) একজন গাড়ি চালক। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের পাশের পূর্ব সুলতানপুর গ্রামের বাসিন্দা। নিজের বসতবাড়ি, জমি-জমা নেই। টিনের দুই চালা ঘর তৈরি করে সরকারি জমিতে বসবাস করেন। অর্ধেক ফসল দেওয়ার চুক্তিতে দুই কেদার বোরো জমি চাষ করেছিলেন। ধানও মোটামুটি ভালই হয়েছিল। কিন্তু পাহাড়ি ঢলের দ্বিতীয় দফায় বন্যা হঠ্যাৎ করে তলিয়ে গেছে সেই জমিটুকু। রাতারাতি পরিবারের ছেলে-মেয়েকে নিয়ে মাত্র তিন মণ ধান তোলেছেন। বানের পানিতে বোরো জমির সাথে কয়েক ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে বসতবাড়ি। রাতের আধারে স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে ও আসবাবপত্র নিয়ে দৌঁড়ে ঠাই নিয়েছেন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে। বন্যার পানিতে বসতঘরের বেড়া, খুঁটি, দরজা ও ভিটের মাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি সহায়তা না পেলে ঘর মেরামত করা কঠিন হবে বলে জানান তিনি।
শুধু শাহ আলমই নয়। পূর্ব সুলতানপুর গ্রামের অন্তত ৫০ টি পরিবারের বসতভিটা কোমড় পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। সবাই প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে ও আশপাশের আশ্রয় কেন্দ্রে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও পূর্ব সুলতানপুর গ্রামের লোকজন এখনও বাড়ি ফিরতে পারেনি। তাদের বসতবাড়ি ও আশপাশের রাস্তায় এখনও পানি রয়েছে।
একই গ্রামের বাসিন্দা মইনুল ইসলাম (২৭) বললেন,‘ বৈশাখ মাসের শেষ হতে না হতেই এমন বন্যা জীবনেও দেখিনি। রাস্তা-ঘাট, বাড়ি-ঘর কোমড় পানির নিচে ডুবে গিয়েছিল। পানির ঢেউয়ে ঘরের বেড়া ভেঙেছে ও মাটি চলে গেছে। পানি কমতে শুরু করেছে তবে এখনও ঘরের ভেতরে পানি রয়েছে। ভাঙা ঘর-দরজা কীভাবে ঠিকঠাক করব এই চিন্তায় আছি।’
জানা যায়, মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে সুনামগঞ্জে দুই দফা বন্যায় চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সাধারণ মানুষ। এপ্রিল মাসের শুরুতে পাহাড়ি ঢলে আগাম বন্যায় ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর বোরো জমির ফসল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন হাওরপাড়ের প্রায় ৩০ হাজার কৃষক। আগাম বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আবারও পাহাড়ি ঢলের পানিতে বন্যা কবলিত হয় সুনামগঞ্জ সদর, বিশ^রম্ভরপুর, তাহিরপুর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার অন্তত লাখো মানুষ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায়।
বন্যায় ঠিক কত মানুষ বা কতটি পরিবার দ্বিতীয় দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই তথ্য নেই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ত্রাণ ও পুনর্বাসণ শাখায়। বৃষ্টিপাত কমায় বন্যা পরস্থিতির উন্নতি হলেও দুর্ভোগে পড়েছেন নিচু এলাকার অনেক মানুষ। বিশেষ করে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও স্যানিটেশন দুর্ভোগে পড়েছেন। তবে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, বন্যা কবলিত লোকজনকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এবং বন্যা পরবর্তী মোকাবিলার জন্য সবধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।
বৃষ্টিপাত কমায় নদীর পানি কমলেও দুর্ভোগে পড়েছেন নিচু এলাকার লোকজন। বিশুদ্ধ খাবার পানি ও স্যানিটেশন দুর্ভোগে পড়েছেন। এখনও অনেক মানুষ পানি বন্দী। রাস্তাঘাট, পুকুর, ময়লা, আবর্জনার স্তুপ, ড্রেন ও লেট্রিন ডুবে একাকার হয়ে যাওয়ায় গৃহস্থালী কাজের জন্য ব্যবহারযোগ্য পানির দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। কোথাও কোথাও খাবার পানি সংকট ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে।
জেলার বিভিন্ন এলাকায় ২০ টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৩০০ টি পরিবার আশ্রয় নিলেও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় গতকাল মঙ্গলবার থেকে সবাই বাড়ি ফিরে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম। বন্যার ক্ষয়-ক্ষতির তথ্য প্রতিটি উপজেলায় চাওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত বলেন,‘ পৌরসভার নবীনগর, হাছননগর, পাঠানবাড়ি, সুলতানপুর, কালীপুর, জলিলপুরসহ আরও কিছু এলাকার মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যা কবলিত লোকজনদের ৫ মে. টন চাল ও শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে কিছু এলাকার পানি ধীর গতিতে নামছে। বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলা ও রোগবালাই প্রতিরোধে আমরা দ্রুত পরিস্কার-পরিছন্ন কাজ শুরু করব। বন্যায় ক্ষয়-ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যাদের ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদেরকে পৌরসভার ও সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে।’
সুনামগঞ্জের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম বললেন,‘ কোথায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয়নি। বন্যা পরিস্থিতিতে জেলায় পাঁচ লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ৭০ হাজার ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। যেসব নলকুপ পানিতে নিমজ্জিত হয়েছিল সেগুলো উঁচু করা হয়েছে। কোথায় জরুরিভিত্তিতে বিশুদ্ধ পানি ও অস্বায়ী লেট্রিন তৈরির প্রয়োজন হলে সব ধরনের মালামালের প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’
সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. আহমদ হোসেন বলেন,‘ বন্যার পরবর্তী কোথাও পানি বাহিত রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাদ দেখা দেয়নি। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে পর্যাপ্ত পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট রয়েছে। কোথাও রোগ-বালাই দেখা দিলে বা পানি বিশুদ্ধকরণের প্রয়োজন হলে তাৎক্ষণিক সেবা প্রদানের জন্য আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।’
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বললেন,‘ ভারি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে যেসব এলাকায় মানুষের বাড়িঘরে পানি উঠেছে তাদের বাড়িবাড়ি প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। যারা বন্যা কবলিত হয়েছে পর্যায়ক্রমে তাদের কাছে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ১৭৫ মে. টন চাল, ১২ লক্ষ নগদ টাকা ও চার হাজার বস্তা শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। সহায়তার আরও চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কোন মানুষই সরকারি সাহায্যের বাহিরে থাকবে না। পানি নেমে যাওয়ার পর যাতে পানি বাহিত রোগ ছাড়াতে না পরে সেজন্য স্বাস্থ্য বিভাগ তৎপর আছে। পানিতে টিউবওয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের মাধ্যমে মেরামত করে দেওয়া হবে এবং কোথাও সুপেয় পানির প্রয়োজন হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসণের জন্য মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী মহোদয় জেলার ১২ টি উপজেলায় ৫০০ বান্ডিল করে ছয় হাজার বান্ডিল ঢেউটিন বরাদ্দের জন্য ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালনের মাননীয় মন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন। আমরা আশা করছি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঢেউটিন ও নগদ টাকা পাওয়া যাবে। যাদের বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদেরকে ঢেউটিন দেওয়া হবে। ’