নিউজ ডেস্ক :: জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রভাতী কবিতার সেই বিখ্যাত দুই পঙক্তির ‘ভোর হলো দোর খোলো খুকু মনি ওঠোরে! ঐ ডাকে জুঁইশাখে ফুল-খুকি ছোট রে!’ সুরে সুর মিলিয়ে বলা যায়-‘ভোর হলো, ফর্সা হলো দলে দলে ছোট রে, ওই ডাকে পদ্মা ডাকে সবাই মিলে চলো রে’। হ্যাঁ মাদারীপুরের শিবচর এবং শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে শনিবার সবাই দলে দলে ছুটছেন। এ ছুটে চলা ইতিহাসের সাক্ষী হতে, এ ছুটে চলা পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে শামিল হওয়া, এ ছুটে চলা জনসমুদ্রে অংশ নেওয়া। আর এই জনসমুদ্রে অংশ নিতে সূর্য ওঠার আগেই দলে দলে চলে এসেছে হাজার হাজার মানুষ। ছুটে এসেছেন দূর-দূরান্ত থেকে। সকালই সকালই ভরে উঠেছে সমাবেশ স্থল।
শনিবার ছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সব অপেক্ষার পালা শেষে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হলো শনিবার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বিশাল সমাবেশে অংশ নিতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে দলে দলে ছুটে আসেন হাজার হাজার মানুষ। কেউ আসেন বাসে চড়ে, কেউ ট্রাকে, কেউ অটোতে চেপে, কেউ বা পায়ে হেঁটে। সবার গন্তব্য ওই সমাবেশস্থল যেখানে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভোরের সূর্য ওঠার আগেই মূল সমাবেশের অনেক দূর থেকেই গাড়ির লম্বা সারি হয়ে গেছে। অগত্যা দুই-তিন কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ছুটছেন সবাই সমাবেশ স্থলে।
সকাল ৮টার মধ্যেই সমাবেশের মূল মঞ্চের সামনের অনেকাংশই ভরে যায় মানুষে। আগে এসে আগে বসতে হবে, তাই অনেকেই চলে এসেছে সকাল সকাল। একেক জন একেক রকম সাজে, বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে, নেচে-গেয়ে অংশ নিচ্ছেন আজকের এই মহা জনসমুদ্রে। কেই আবার অসুস্থ অবস্থায় আরেকজনের ঘাড়ে ভর করে ছুটে এসেছেন ইতিহাসের সাক্ষী হতে। সব মিলে পদ্মা পাড়ে কাঁঠালবাড়ি ও বাংলাবাজার ঘাটের মধ্যবর্তী স্থানের সমাবেশস্থল বিশাল জনসমুদ্র ও উৎসবের স্থলে পরিণত হয়েছে।
সে এক অন্যরকম উন্মাদনা, অন্য রকম উদযাপন। নেচে-গেয়ে, বাদ্য বাজিয়ে দলে দলে মানুষ সমবেত হয়েছিল পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের সমাবেশে। কেউ এসেছেন সারা রাত না ঘুমিয়ে, কেউ এসেছে ১০ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে, কেউ আবার ভাঙা পা নিয়ে ক্র্যাচে ভর দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটের পাশে যে বিশাল প্যান্ডেল করা হয়েছিল সেখানে এভাবেই মানুষ এসেছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে। তারা এসেছিলেন এক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হতে। দেশের মানুষের মর্যাদার প্রতীক পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে লাখো মানুষ হয়েছে ইতিহাসের অংশ।
সমাবেশ স্থলে জনতার ঢল শুরু হয় তখন, যখন সূর্যও উঁকি দেয়নি। ভোর থেকেই দলে দলে সমাবেশে আসতে শুরু করে মানুষ। ভোর ৬টার থেকেই সমাবেশের প্রায় ১০ কিলোমিটার দূর থেকে গাড়ির জটলা লেগে যায়। অগত্যা এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েই তারা এসেছেন। সড়ক পথের পাশাপাশি নৌপথে ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের লঞ্চ, ট্রলার, ডিঙি নৌকায় করেও এসেছেন হাজার হাজার মানুষ। নৌকাগুলো সাজানো হয়েছিল মনোরম সাজে। সারিবদ্ধভাবে নৌকাগুলো যখন আসতে শুরু করে তখন অপরূপ দৃশ্য তৈরি হয় পদ্মার বুকে।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিনে কি ঘরে বসে থাকা যায়। ঠিক তেমনি বসে থাকতে পারেননি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কবীর মাহমুদ। হঠাৎ হোন্ডা দুর্ঘটনায় ভেঙে যায় ডান পা। সেই ভাঙা পা নিয়েই ক্র্যাচে ও এক আত্মীয়ের ঘাড়ে ভর দিয়ে চলে এসেছেন পদ্মা পাড়ের এই মহা জনসমুদ্রে। এই ভাঙা পা নিয়েই তাকে হাঁটতেও হয়েছে প্রায় ২ কিলোমিটার রাস্তা। শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছেন সমাবেশ স্থলে-এতেই স্বস্তি।
ভাঙা পা নিয়ে এতো কষ্ট করে কেন আসলেন সমাবেশে। জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, কতো প্রতীক্ষা, কতো অপেক্ষা করে ছিলাম এই দিনটির জন্য। অথচ দুই দিন আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আমার ডান পা ভেঙে যায়। আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। ভাবলাম পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিন উপস্থিত থেকে ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া আর হলো বোধ হয়। কিন্তু আমি হাল ছাড়া মানুষ না। আমার পরিবার-পরিজন, এমনকি চিকিৎসকও নিষেধ করেছেন যেন ভাঙা পা নিয়ে বাইরে না যায়। এক মাসের জন্য বিশ্রামে থাকতে বলেছেন ডাক্তার। কিন্তু আমি কোরো কোনো কথা শুনিনি। সব কিছু উপেক্ষা করে ছুটে এসেছি সামাবেশে।’
তিনি বলেন, এক মাস বা দুই মাসে হয়তো আমার পা ভালো হয়ে যাবে, কিন্তু আমি তো আর তখন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পাবো না। তাই আমার অনেক কষ্ট হয়েছে, তবুও সব বাধা পেরিয়ে আমি সমাবেশে চলে এসেছি ইতিহাসের সাক্ষী হতে। সমাবেশে পৌঁছে গেছি, এখন আমার সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে। আমার আর কোনো কষ্ট নেই।
দীর্ঘ পথ হেঁটে অসুস্থ হয়ে মেডিকেল ক্যাম্পে অনেকে : সমাবেশে আসা লাখ লাখ মানুষের কেউ যদি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে তার জন্য এখানে ছিল মেডিকেল ক্যাম্প। সমাবেশ স্থলের তিন কর্নারে তিনটি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এখানে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর এবং ফরিদপুর হাসপাতাল থেকে ১৪৫ জনের মেডিকেল টিম আসে। এর মধ্যে চিকিৎসক ছিলেন ৪৫ জন। বাকিরা নার্স ও চিকিৎসা সহকারী। মেডিকেল ক্যাম্পে প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদেরও চিকিৎসা দেবার ব্যবস্থা ছিল।
ক্যাম্পে দায়িত্বরত মাদারীপুর সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আহসান হাবিব বলেন, আমরা এখানে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য সব রকম ব্যবস্থা করেছি। এছাড়া কেউ যদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে তাদেরও চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যেমন এখানে দুই জনকে বেডে ভর্তি করে রাখা হয়েছে। কারণ তাদের আশারীরিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে পড়েছিল। এছাড়া এখানে খাবার স্যালাইন, প্যারাসিটামল, গ্যাস্টিকের ট্যাবলেটসহ প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। সকাল থেকে ৫ শতাধিক লোক এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। মূলত দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে আসায় অনেকেই শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন।