নাইন্দা নদীর ভাঙনে বিলীন সদরপুরের গাঙেরহাটি

রিপোর্টার নামঃ
  • শনিবার, ১৬ জুলাই, ২০২২
  • ১৪৩ বার পড়া হয়েছে

নিউজ ডেস্ক :: নিম্ন আয়ের মানুষ হরিবল দেব। দিনমজুরি করে কোনো রকমে চলে সংসার। দুই সন্তান, স্ত্রীসহ চার জনের সুখী পরিবার এই মানুষটির। এই সুখের সংসারটাই পড়তে যাচ্ছে আজন্ম দুঃখে। পাঁচ পুরুষের ভিটা-মাটিতে অনেক দূরে শেকড় মেলেছিলেন তিনি। সে শেকড়েই টান মেরেছে সর্বনাশা নদী। নদীগর্ভে ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে তাঁর বসতঘর। যেখানে বাস ছিল তাঁর পাঁচ পুরুষের, আজ সে ভিটাহারা নদী ভাঙনের করালগ্রাসে। আশ্রয় নিয়েছেন সদরপুরের ভাগ্নে ভক্ত দাসের বাড়িতে। এ গল্প শুধু তাঁর একার নয়। নদী ভাঙার আগ্রাসনে বাড়ি ছেড়েছেন নারায়ণ দেব, আনোয়ার হোসেন, ইসমাইল উদ্দিন ও প্রদীপ দেবও। তাঁরাও আশ্রিত আছেন ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। দুইপাড়ে এখনো ভাঙছে নদী। আতঙ্কে আছেন নদীর পাড়ে বসত করা প্রায় ২৫টি পরিবারের শতাধিক মানুষ। আর অপেক্ষা করছেন বাড়ি ছাড়ার।

নদীতে বসতভিটা ভেঙে যাওয়ার এ করুন গল্প শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের সদরপুর গ্রামের পুরানবাড়ির। অনেকে এ পাড়াকে গাঙেরহাটি বলেও চিনেন। মহাসিং নদী থেকে নাইন্দা নদী নাম ধারণ করে কামরূপদলং হয়ে সদরপুরে মিশেছে এ নদী। নদী বলতে সদরপুরের বড়খাল। নাইন্দা নদীর শাখা। অনেকে নাইন্দা নদী বলেও চিনে থাকেন। সদরপুরের ব্রিজ যে নদীর উপর দিয়ে বয়ে গেছে। সংযুক্ত করেছে সুনামগঞ্জ-সিলেট মহাসড়ককে। ভাঙন ধরেছে ব্রিজটির বিভিন্ন অংশেও। কিছুদিন আগে ব্রিজটির পশ্চিমাংশ থেকে মাটি সরে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ ছিল সুনামগঞ্জের সাথে বেশ কিছুক্ষণ। সড়ক ও জনপথের লোকজন দ্রুত মেরামত করে ঘণ্টা-দুয়েকের চেষ্টায় মূল সেতুর সাথে সংযোগ দেয় সরু সেতুর। এখনো এভাবেই চলছে। মূলত, সদরপুর গ্রামের নদীঘেঁষা পাড়াগুলোর দুঃখের নাম এখন সদরপুর বড়খাল বা নাইন্দা নদী। সদরপুর সেতুর দক্ষিণ পাশের পশ্চিমপাড় পুরোটাই গিলে খেয়েছে ভাঙন। নিঃস্ব করেছে অনেক কৃষককেও। এখন টান মেরেছে গাঙেরহাটিতে। আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন দুইপাড়ের শতাধিক মানুষ।

নদী ভাঙন নিয়ে এ প্রতিবেদকের কথা হয় ভুক্তভোগী একাধিক পরিবারের সাথে। তাঁরা জানান, শতাব্দী বছর ধরে তাদের পূর্ব পুরুষেরা এ নদীর ধারে বসত করে গেছেন। নদী তখন এতো আগ্রাসী ছিল না। এখন তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ৬টি পরিবারের ভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বাকী যারা আছে তারাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন ভিটা ছাড়ার। প্রতিদিনই নদী ভাঙছে। এ বন্যায় তাদের আরও ক্ষতি করেছে। এখন নদীতে পানি আছে, যখন পানি কমবে তখন পাড় আরও ভাঙবে। তারা জানান, এখনো স্থানীয় কোনো জনপ্রতিনিধি তাদের এ দুঃখ দুর্দশা দেখতেও যাননি। তারা দাবি করেন, যেহেতু তাদের থাকার মতো আর কোনো জায়গা নাই, তাই তাদেরকে সরকারি তত্বাবধানে পুনর্বাসন করা হোক।

ঝাঁনকি বিশ্বাস ও আউয়াল মিয়া নামের দুইজন ভুক্তভোগী জানান, তাঁদের পূর্ব পুরুষের এখানে বড় হয়েছে, মৃত্যুবরণ করেছেন। সন্তানেরা নদীর সাথে মিতালী করে বেড়ে উঠেছে। সর্বনাশা নদী এখন তাদের গিলে ফেলছে। কোথায় যাবেন সে চিন্তাই এখন তাঁদের মাথায়। পুনর্বাসন চান তারা।

পার্শ্ববর্তী কামরূপদলং গ্রামের মুরব্বি আবদুল হক বলেন, আমার বয়সে এতো ভাঙন আগে দেখিনি। ইদানীং খুব বেশি পাড় ভাঙছে। এখন তো নদীতে পানি বেশি। শীতকালে পানি কমবে। তখন নদীর পাড়ে সমস্ত ‘দফলা’ ভেঙে পড়বে।

তাঁর কথার সাথে একমত পোষণ করেন জয়কলস ইউপির ২নং ওয়ার্ড সদস্য মো. আশিক মিয়া। তিনি বলেন, নদী ভাঙনে ৫/৬টি পরিবার বসতভিটা ছেড়েছে। বাকীরাও থাকতে পারবেন না। তাদের সকলেরই পুনর্বাসন জরুরি।

এ পাড়াতেই বসবাস করেন শান্তিগঞ্জ উদীচীর সভাপতি শ্যামল দেব। তার বসতেরও ভাঙনের মুখে। পূর্ব পুরুষের ভিটা-মাটি ছেড়ে দু’চারদিনের মধ্যে তিনিও হয়তো শান্তিগঞ্জে ভাড়া বাসায় উঠবেন। আক্ষেপ করে শ্যামল দেব বলেন, আমাদের পাঁচ পুরুষ এখানে জীবন কাটিয়েছেন। নাইন্দা নদীর জলে-খেলে আমাদের বেড়ে উঠা। এখানে আমাদের এক একরের চেয়ে বড় বাড়ি ছিল। শুধু আমাদের না, সবার বাড়িই বড় ছিল। ভাঙতে ভাঙতে আজ আমরা ভিটাহারা। প্রায় ৩০টি পরিবারের ঘর এখনো শঙ্কার মধ্যে আছে। বাড়ি ছাড়ছেন সবাই। যে যেদিকে পারছেন আশ্রয় নিচ্ছেন। আমি প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাই, ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে যত দ্রুত সম্ভব পুনর্বাসনের আওতায় নিয়ে আসা হোক। শ্যামল দেব দুঃখ প্রকাশ করে আরও বলেন, দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, স্থানীয় ওয়ার্ডের মেম্বার ছাড়া এখনো স্থানীয় অন্য কোনো রাজনীতিবিদ, প্রশাসনের কেউ বা জনপ্রতিনিধি এই নদী ভাঙন এলাকাটি পরিদর্শন করেননি।

শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান প্রভাষক নূর হোসেন বলেন, বন্যায় আমরা ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। বিষয়টি প্রথমে জ্ঞাত ছিলাম না। পরে স্থানীয় মুরব্বিদের মাধ্যমে জেনেছি। অত্যন্ত দুঃখজনক। আপাতত তারা নিরাপদ যায় থাকুক। ঘর বানানোর মতো জায়গা যদি তাদের না থাকে তাহলে মন্ত্রী মহোদয় আসার পরে মুরব্বিদের নিয়ে তাঁর সাথে কথা বলে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।

শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনোয়ার উজ্ জামান বলেন, ভাঙনের বিষয়টি আমি জানি। স্থানীয় ইউপি সদস্য ও আমাদের একজন কর্মকর্তার দ্বারা একটি ক্ষতিগ্রস্ত তালিকা করিয়েছি। আমার ধারণা তাদের নাম এ তালিকায় আছে। আগামী এক দুই সপ্তাহের মধ্যে তারা কিছু টাকা হয় তো পাবেন। এরপরও আমি গিয়ে তাদের দেখে আসবো। পরিদর্শনের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

আরো সংবাদ পড়ুন
© All rights reserved © 2021 Anushondhan News
Developed by Host for Domain