অনুসন্ধান নিউজ :: শিশুদের পুষ্টিহীনতা তিনটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে যাচাই করা হয়- খর্বকায়, শীর্ণকায় ও স্বল্প ওজন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের শিশুদের মধ্যে খর্বকায় ২৮ শতাংশ, শীর্ণকায় ১০ শতাংশ আর স্বল্প ওজনের ২৩ শতাংশ। তবে চা বাগানে এই হার দ্বিগুণ।
চা বাগানের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে এ পর্যন্ত করা একমাত্র জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাগানের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪৫ দশমিক ১ শতাংশ খর্বকায়, ২৭ শতাংশ শিশু শীর্ণকায় আর স্বল্প ওজনের ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
সিলেট বিভাগের চা বাগানগুলোর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে ২০১৮ সালে ইউনিসেফেরে সহায়তায় একটি জরিপ চালায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। এতেই পাওয়া যায় বাগানের শিশুদের পুষ্টিহীনতার ভয়াবহ চিত্র। পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জীবনযাত্রায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন পুষ্টিহীনতা নিশ্চিতভাবেই আরও বেড়েছে। তবে নতুন করে কোনো জরিপ না হওয়ায় বর্তমানের চিত্রগুলো আর পাওয়া যায়নি।
বৃহস্পতিবার সিলেটের দুটি বাগান ঘুরে শিশুদের পুষ্টিহীনতার যে চিত্র দেখা গেল, তা লিখে বর্ণনা করা কঠিন।
লাক্কাতুরা চা বাগানের শ্রমিক নমিতা লাহারের দুই ছেলে। বড়টির বয়স ১১, ছোটজনের ৯। কিন্তু দেখলে মনে হয় এদের বয়স ৫ থেকে ৬। কারণ বয়সের তুলনায় বেড়ে ওঠেনি তারা।
নিজেদের ভাষায় নমিতা যা বললেন, শুদ্ধ ভাষায় লিখলে হয় এমন: ‘আমরা গরিব মানুষ। বাচ্চাদের ভালোমন্দ খাওয়াতে পারি না। সারা দিন কাজে থাকি। তাই যত্ন নিতে পারি না।
‘এমনকি ছোট থাকতে ঠিকমতো বুকের দুধও খাওয়াতে পারিনি। এখন তাদের বয়স বাড়লেও শরীরের দিক দিয়ে বড় হচ্ছে না। টাকার অভাবে ডাক্তারও দেখাতে পারছি না।’
পাশের মালনীছড়া বাগানের শিশু সোহাগ মোদী। পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। একেবারে হাড় জিরজিরে শরীর তার। উদোম গায়ে সবকটা হাড়ই গোনা যায়।
সোহাগের বাবা আশোক মোদীও বাগানে কাজ করেন। তারও একই কথা, ‘বাচ্চারে ঠিকমতো খাওয়াতে পারি না। ডাক্তার দেখাইতে পারি না। স্বাস্থ্য হবে কী করে?’
মানহীন আবাসন, সেই সঙ্গে কিছু রেশন সুবিধার বাইরে দিনে ১২০ টাকা মজুরিতে একজন শ্রমিকের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহ করা কতটা কঠিন, তা শ্রমিক ও তাদের সন্তানদের দেখলেই বোঝা যায়।
বাগানের ছেলেশিশুদের গায়ে জামা থাকলেও ভদ্রলোকের বাড়ির ঘর মোছার কাপড়ের মতো। শত ছিন্ন পোশাকও পরে থাকে অনেকে।
সিলেট সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আহমদ সিরাজুম মুনীর। চা বাগানের শিশুদের করোনার টিকা প্রদান কার্যক্রম সমন্বয়ক।
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দেশে যত জনগোষ্ঠী আছে, তাদের মধ্যে পুষ্টির দিক দিয়ে সব চেয়ে পিছিয়ে আছে চা বাগানের শিশুরা। এখানকার শিশুরাই ভয়াবহ অপুষ্টিতে ভুগছে।’
কেন এমন চিত্র- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ জন্যই তো তাদের আন্দোলন। মা-বাবা ১২০ টাকা মজুরি পেলে সন্তানদের পুষ্টি হবে কোথা থেকে?’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক হিমাংশু লাল রায় বলেন, ‘সিলেট বিভাগের চা বাগান, হাওরাঞ্চল ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যসেবায় পিছিয়ে। এ কারণে স্বাস্থ্যের বিভিন্ন মানদণ্ডে সিলেটও পিছিয়ে।’
চা বাগান, হাওর ও আদিবাসীদের নিয়ে আলাদা জরিপ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আগে তো আমরা বাগানে ঢুকতেই পারতাম না। কর্তৃপক্ষ ঢুকতে দিত না। তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের চিকিৎসা দিত। এখন আমরা কিছু সেবা নিয়ে বাগানে ঢুকতে পারছি। ফলে পরিস্থিতি আগের চেয়ে এখন কিছুটা উন্নত হচ্ছে।’
ন্যাশনাল টি বোর্ডের তথ্যমতে, দেশে চা বাগান রয়েছে ১৬৬টি। এর মধ্যে ১৩৮টিই সিলেট বিভাগে। আর চা-শ্রমিক রয়েছে প্রায় দেড় লাখ। যৎসামান্য মজুরির কারণে দেশের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অন্যতম তারা।
জীবনমানের সব সূচকেই পিছিয়ে এই জনগোষ্ঠী। দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে আন্দোলন করছেন তারা।
বাগান মালিকদের দাবি, এই মজুরির বাইরেও কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। এগুলোর আর্থিক মূল্য বিবেচনায় মজুরি হয় ৪০২ টাকা। তবে এই সুযোগ-সুবিধার মধ্যে মালিকপক্ষ বাগানের ভেতর থাকার জন্য তুলে দেয়া ছাপরা ঘরে দিনে ৭০ টাকার বেশি অর্থাৎ মাসে ২ হাজার ২০০ টাকা ধরেছে, সেই সঙ্গে যে ফলমূল চাষ করেন শ্রমিকরা তার বিপরীতে দিনে ১৪ টাকা আর মাসে ৪২০ টাকা মজুরি ধরেছে। ওভারটাইম, নামমাত্র শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধা যেটি দেয়া হয়, সেটিও ধরেছে, যদিও আইন অনুযায়ী এর কিছুই মজুরিতে পড়ে না।
মাঝে শ্রমিকদের মজুরি ২৫ টাকা বাড়িয়ে একটি চুক্তি হয়েছিল। তবে নেতারা মেনে নিলেও মানেননি শ্রমিকরা। তাদের আবার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চা বাগান মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন।
চা-শ্রমিকদের মধ্যে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। সম্প্রতি তাদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘মা’ সম্বোধন করে বলা হয়েছে, তাদের মা যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তারা তাই মেনে নেবেন।
জরিপের চেয়ে চা বাগানের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি আরও খারাপ বলে মনে করেন বাংলাদেশ চা সংসদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল। তিনি বলেন, ‘অর্ধেক কীসের? চা বাগানের সব শিশুই তো অপুষ্টির শিকার। দুই-চারজন ব্যতিক্রম ছাড়া এখানকার কোনো শিশুই ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। সামান্য মজুরি দিয়ে শিশুদের পুষ্টির জোগান দেয়া শ্রমিকদের পক্ষে সম্ভব হয় না।’
তবে বাগান মালিকরা এর মধ্যেও শিশুদের পুষ্টি পরিস্থিতি ‘অনেক ভালো’ দেখার দাবি করছেন।
চা-শিল্পের উদ্যোক্তা ও সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আফজাল রশীদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিটি বাগানে এখন চিকিৎসক, নার্স, মিডওয়াইফের ব্যবস্থা রয়েছে। শিশুদের দেখভালের জন্যও রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। এর মধ্যেও অভ্যাসগত কারণে কিছু শ্রমিক এবং তাদের সন্তানরা অপুষ্টিতে ভুগতে পারে।’
চা বাগানের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে আরেকটি জরিপ কার্যক্রম চলমান রয়েছে জানিয়ে সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন জন্মেজয় দত্ত বলেন, ‘এখন পর্যন্ত একমাত্র যে জরিপ হয়েছে তা কয়েক বছর আগের। এখনকার পরিস্থিতি কী, তা জানতে একটি জরিপ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই জরিপের ফলাফল পেলে সে অনুযায়ী চা বাগানগুলোতে কার্যক্রম জোরদার করা হবে।’