নিউজ ডেস্ক :: বাগেরহাটের নারী উদ্যোক্তা মনু বেগমকে হত্যার ১৭ বছর পরে কবিরাজ ছদ্মবেশী প্রতারক হেমায়েত ওরফে জাহিদ কবিরাজকে (৫২) গ্রেফতার করেছে র্যাব। বুধবার দিবাগত রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারের পরে কবিরাজ ছদ্মবেশী জাহিদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় র্যাব। ১৫ বছর বয়স থেকে কবিরাজি পেশা শুরু করে জাহিদ। বিভিন্ন ছদ্মবেশে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন তিনি। মূলত নারীরাই ছিল তার প্রতারণার মূল টার্গেট। ২০০৫ সালে বাগেরহাটের নারী উদ্যোক্তা মনোয়ারা মনু বেগমকে অর্থ ও জমির কারণে হত্যা করে জাহিদ। সেই মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন জাহিদ।
বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে বাগেরহাট জেলার সদর এলাকায় মনু বেগম নামে এক নারীর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হেমায়েতসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে বাগেরহাট থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়। মামলাটির তদন্ত শেষে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ২০০৯ সালের জুন মাসে বিজ্ঞ আদালত আসামি হেমায়েতকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদান করেন। এরপর থেকে বিভিন্ন ছদ্মবেশে হেমায়েত ওরফে জাহিদ কবিরাজ পলাতক ছিলেন। দীর্ঘ ১৭ বছর পরে এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ও ছদ্মবেশী প্রতারক কবিরাজকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
এসময় তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় কবিরাজি চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের আংটি- ১২৯টি, বক্স-০১টি, শঙ্খ-০৩টি, আলাদিনের চেরাগ-০১টি, ক্রেস্ট-০২টি, কবিরাজি সংক্রান্ত বই-১৫টি, পিতলের পাঞ্জা-০১টি ও কবিরাজি সংক্রান্ত অন্যান্য সরঞ্জামাদি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত মনু হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছে।
মনু হত্যার ঘটনা বর্ণনা দিয়ে র্যাবের মুখপাত্র বলেন, কবিরাজি পেশায় তার অন্যতম সহযোগী ছিল মনু হত্যা মামলার অপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সোবহান। ২০০৫ সালে জানুয়ারি মাসে সোবহান ভিকটিম মনুকে মাথা ব্যাথার রোগকে মানসিক রোগ বলে আখ্যায়িত করে কবিরাজি চিকিৎসার জন্য হেমায়েত এর নিকট নিয়ে আসে। ভিকটিম মনুর স্বামী ঢাকায় চাকুরি করত এবং প্রতিমাসে সংসারের খরচ চালানোর জন্য মনুর নিকট টাকা পাঠাত। মনু তার জমানো টাকা দিয়ে কাপড়ের ব্যবসা করত এবং নারী উদ্যোক্তা হয়ে উঠেন। কাপড়ের ব্যবসা করে এবং স্বামীর পাঠানো টাকা জমিয়ে মনুর নিকট লক্ষাধিক টাকা জমা হয়। এই অর্থের প্রতি হেমায়েত এর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। হেমায়েত মনুর সরলতার সুযোগে তার টাকা পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে মনুকে টার্গেট করে।
তিনি আরও বলেন, গ্রেফতারকৃত হেমায়েত ভিকটিম মনুকে কিছু ভেষজ উপাদানের মাধ্যম নিয়মিত ঘুমের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করে। একপর্যায়ে মনুকে তার যাবতীয় সম্পত্তির দলিলপত্র এবং টাকা পয়সা শত্রু পক্ষের জ্বীনের আক্রমনে পড়তে পারে বলে ভয় ভীতি দেখিয়ে তার যাবতীয় সহায় সম্পত্তির দলিলপত্র নিরাপত্তার জন্য হেমায়েত পীরের নিকট জমা রাখার জন্য মনুকে উদ্বুদ্ধ করে। নিয়মিত ভেষজ উপাদান সেবনের ফলে ভিকটিম মনুর ঘুম হয় এবং মাথা ব্যাথার প্রবণতা কিছুটা কমে আসলে হেমায়েত এর উপর ভিকটিমের আস্থা তৈরী হয়। পরবর্তীতে ভিকটিম সরল বিশ্বসে তার টাকা পয়সা ও সম্পত্তির দলিল হেমায়েত এর নিকট জমা রাখে। মনুর সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হেমায়েত সহযোগীসহ তাকে চেতনানাশক ঔষধ খাইয়ে দলিলপত্রে টিপসই নিয়ে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে মনুর জ্ঞান ফিরে আসলে সে পুলিশের নিকট গিয়ে অভিযোগ করার জন্য উদ্ধত হলে মনুর সাথে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সহযোগীর সহযোগিতায় হেমায়েত মনুকে কুপিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত গলা কেটে তার হত্যা নিশ্চিত করে। এরপর রাতের অন্ধকারে মনুর গলাকাটা লাশ বস্তাবন্দি করে হেমায়েতের বাড়ির সামনের খালের অপর পার্শ্বে ধান ক্ষেতে লুকিয়ে রাখে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ছদ্মবেশে এই প্রতারক কবিরাজ মিরপুরে ৩ বছর অবস্থানের পর তার প্রতারণার বিরুদ্ধে জনরোষ সৃষ্টি হয়। পরে ঠিকানা পরিবর্তন করে কিছুদিন আদাবর, কিছুদিন কেরানীগঞ্জ এবং সর্বশেষে বিগত ৫ বছর যাবৎ মোহাম্মদপুর বসিলায় বিভিন্ন স্থানে কবিরাজি ব্যবসার আড়ালে প্রতারণা করছে জসিম। সে তার বশবর্তী জ্বীনের বাদশার মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কথা বলে নতুনভাবে প্রতারণার করেছে। সাধারন মানুষের নিকট হতে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নেয়।
মূলত সে নারীদের টার্গেট করে জ্বীনের বাদশার মাধ্যমে নারীদের বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও পারিবারিক সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে দীর্ঘদিন যাবৎ সে কবিরাজি ব্যবসা চালিয়ে আসছে। গত দুই মাসের মধ্যে সে কিছুদিন পর পর পিরোজপুর, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ এবং মিরপুরে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। তার পরিচয় গোপন রাখার জন্য সে মাঝে মাঝেই তার চুল দাড়ি রং পরিবর্তন, পোশাকের ধরন পরিবর্তন করেছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই আসামমি একাধিক প্রতারক মামলায় জেলও খেটেছে। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।