নিউজ ডেস্ক :: জরুরি কোনও কাজে একা বের হয়েছেন। চলার পথেই কেউ একজন হয়তো কুশল বিনিময় করে এসে আলাপ শুরু করলো কিংবা জানতে চাইলো কোনও ঠিকানা। আর ভদ্রতা করে শুরু হওয়া এই আলাপেই আপনি খুইয়ে ফেলতে পারেন সর্বস্ব। জোর করে ছিনিয়ে নিতে হবে না, ক্ষণিকের এই আলাপে আপনি নিজেই আপনার সবকিছু তুলে দেবেন তাদের হাতে। শুনতে অবাস্তব মনে হলেও সম্প্রতি রাজধানীতে এমন প্রতারণার ঘটনাই ঘটছে; এই চক্রগুলোকে বলা হয় খড় পার্টি। সামনে ঈদ ও রমজান মাসকে কেন্দ্র করে এমন প্রতারক চক্র রাজধানীতে সক্রিয় হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
সংস্থাটি জানিয়েছে, গত দুই বছর আগে এ ধরনের চক্রের বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এখন আবার তাদের তৎপরতা বেড়েছে। তারা প্রশিক্ষিত এবং যে কাউকে হিপনোটাইজ করতে পারে।
এই প্রতারকদের কৌশল সম্পর্কে ধারণা দিয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তারা প্রথমে সখ্যতা তৈরি করে কথা বলা শুরু। সাহায্য কিংবা সহায়তার কথা বলে কথাবার্তা এগিয়ে নেয়। তারপর টার্গেটকৃত ব্যক্তির হাতে কোনও কাগজ, মোবাইল বা কোনও কিছু একটা তুলে দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে হিপনোটাইজ হয়ে গেলে টার্গেটকৃত নারী কিংবা পুরুষ নিজে থেকেই সবকিছু তাদের হাতে তুলে দেয়। আর জিনিসপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চম্পট দেয় চক্রটি।
চক্রটির মূল টার্গেট নারীরা। সম্প্রতি রাজধানীর বেশ কয়েকটি থানায় এ ধরনের ঘটনায় অভিযোগ দায়ের করেছেন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী।
ডিএমপি বলছে, সম্প্রতি রাজধানীতে এ ধরনের প্রতারণা করে সঙ্গে থাকা ব্যক্তির কাছ থেকে জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়ার ঘটনাগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, এ ধরনের অপরাধ চক্রের সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশের আবাসস্থল নারায়ণগঞ্জের চনপাড়া বস্তিতে। গোয়েন্দারা এসব বিষয় খতিয়ে দেখছেন।
ঈদ এবং রমজানকে কেন্দ্র করে এসব চক্রের তৎপরতা বাড়ার আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। তবে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন মার্কেটের সামনে বা বিভিন্ন সড়কে বিশেষ নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলেও দাবি তাদের।
সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের সামনে এমন একটি প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েন মরিয়ম রহমান নামে এক নারী। গত শুক্রবার (২৪ মার্চ) তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, তার স্বামীর দুটি কিডনিই নষ্ট। চিকিৎসা নিচ্ছেন মিরপুরের কিডনি হাসপাতালে। অসুস্থ স্বামীর জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে তিনি এই ‘খড় পার্টি’র খপ্পরে পড়েন। তাদের সঙ্গে কথা বলার পর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারান তিনি। এমনকি নিজেই তার স্বর্ণালঙ্কার খুলে তাদের হাতে তুলে দেন।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, গত (১৯ ফেব্রুয়ারি) স্বামীর জন্য ওষুধ কিনতে ফার্মেসিতে যান তিনি। তিনি বলেন, ‘যাওয়ার পথে এক ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করে, এই রাস্তায় কি শিশু হাসপাতালে যাওয়া যায়? প্রথমে আমি সাড়া দেইনি। পরে আবার জিজ্ঞাসা করলে, আ, দেখিয়ে দেই। ওষুধ কিনে হাসপাতালের দিকে ফিরে যাওয়ার সময় আবারও সেই যুবকসহ দুই জন আমার সঙ্গে কথা বলা শুরু করে।
মরিয়ম রহমান বলেন, ‘সেই যুবক বলে— হার্ট ফাউন্ডেশন থেকে গরীবদের সাহায্য করা হচ্ছে। যদি একটু আমাকে সহায়তা করেন, ওখানে গিয়ে যদি একটু বলে দেন যে, আমি গরীব মানুষ। তাহলে তারা আমাকে সহায়তা করবে। তাদের অনুরোধ এতটাই নমনীয় ছিল যে, আমি তাদের সঙ্গে হার্ট ফাউন্ডেশনে যাই। হাসপাতালের সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার হাতে তাদের একটি মোবাইল এবং ৫০০ টাকা দেয় এবং আমাকে অপেক্ষা করতে বলে। চিকিৎসকের সাথে কথা বলার জন্য দুজন যায় কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে। পরবর্তী সময়ে তারা সেই মোবাইল এবং ৫০০ টাকা আমার কাছ থেকে নিয়ে নেয়। তারা আমাকে বলে— এবার আপনাকে চিকিৎসকের সঙ্গে একটু কথা বলতে হবে, আপনি একটু যান। তখন এক যুবক আমাকে বলে— যাওয়ার আগে আপনি আপনার কানের দুল খুলে রেখে যান।’
সেই যুবকদের কথা মতো স্বর্ণের দুল খুলে দেন মরিয়ম রহমান। সেসময় তার হিতাহিত কোনও জ্ঞান ছিল না বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, ‘কেন এবং কীভাবে যে স্বর্ণের দুলগুলো খুলেছি, আমি নিজেও বলতে পারছি না। দুলগুলো আমি প্রথমে আমার হাতেই রাখি। পরে তারা আমার হাত থেকে নিয়ে তারা বলে— আপনি স্যারের সাথে কথা বলে আসেন। তারপর আমাদের কাছ থেকে এগুলো নিয়ে যাইয়েন। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলার জন্য সামনে এগিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই পেছন দিকে তাকিয়ে দেখি ওই দুই যুবক আর নেই। তারা চলে গেছে।’ পরে মিরপুর মডেল থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন এই নারী।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিএমপি গণমাধ্যম শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, ‘ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় অনেকে অভিযোগ দায়ের করছেন। সেগুলো থেকে দেখা গেছে, খর পার্টি নামে এক ধরনের পার্টি রয়েছে। যাদের নারী এবং পুরুষ সদস্য রয়েছে। এই সদস্যরা প্রত্যেকেই প্রশিক্ষিত। তারা বিশেষ করে মানুষকে হিপনোটাইজ করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। এ চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করতে পারলে তাদের কৌশল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতো।’
এসব চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।